ডা. এস. এ. মালেক

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বাস্তবতা

মাত্র ১৯ দিন আগে ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে একটা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী হয়ে নতুন করে সরকার গঠন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বলা যায়, ২০১৮ জাতিকে উপহার দিয়েছে এক অনন্য সরকার। এক দশক ধরে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন ছিলেন। এই এক দশকে তিনি বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিয়ে দেশকে এমন একপর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে উন্নয়নের এক মডেল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা এ রূপ যে, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ মনে করে যে, শেখ হাসিনা মানে উন্নয়ন; শেখ হাসিনা মানে অগ্রগতি; শেখ হাসিনা মানে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সরকার উন্নয়নের পথে দেশ এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণ সাধন কেউ করতে পারেনি। বাংলাদেশের কৃষক আজ প্রায় সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লবের কারণে তাদের এই সচ্ছলতা। মানুষ এখন শুধু পেটভরে খায় না, এমন খাবার খেতে আগ্রহী যা স্বাস্থ্যকে সবল করে। গ্রামে এমন গরিব মানুষ কম আছে; যার সন্তান অর্থাভাবে পড়ালেখা করতে পারছে না। বিনা ব্যয়ে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছে। গ্রামের মানুষ আজ ঘরে বসে স্বাস্থ্যসেবা পায়। বিধবা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, গৃহহীন মানুষ, নদীভাঙা ও পাহাড়ধসা মানুষ, সবার দিকে শেখ হাসিনার দৃষ্টি। কিছুই পাননি সমাজেÑ এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। সম্পদ সৃষ্টি ও দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হয়েছে। তাই জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ায় সর্বস্তরের মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছেন। শুধু অভিনন্দন জানাতে পারেনি তারাই; যারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী নয়। ৭৫-এর প্রতিবিপ্লবের পর হতে যারা বাংলাদেশকে বিপরীত ধারায় পরিচালিত করে স্বাধীনতাকে অর্থহীন করতে চেয়েছিল। আসলে পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও নির্বাচন ১০০ ভাগ অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যে যেখানে সুযোগ পেয়েছে কিছু কিছু অনিয়মতান্ত্রিকতার আশ্রয় নিয়েছে। এ কারণেই সরকার ও বিরোধী দলের কিছু দায়িত্বহীন লোকেরাই দায়ী। তবে ওই রূপ করা না হলেও শেখ হাসিনা যে এবার বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন, তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেকেই আঁচ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। নির্বাচন সম্পর্কে যাই বলা হোক না কেন, নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক ও অংশগ্রহণমূলক যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রথমেই ধরা যাক, নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া। সরকার রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই কমিশন গঠন করেন। এখন প্রমাণিত হয়েছে যে, বিরোধী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল লোক পাওয়া গিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনকে তারা মেনে নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এবং কখনো কখনো তারা নির্বাচন কমিশনকে প্রশংসিত করেছে। নির্বাচনের আগে সরকার ও বিরোধী দলের একাধিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিরোধী দলের মুখপাত্র ড. কামাল নির্বাচনকে ভোট বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন। বিজয় সম্পর্কে তারা এতই সুনিশ্চিত ছিলেন; তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩০ ডিসেম্বরের পর ক্ষমতাসীন দলের অস্তিত্ব থাকবে না। অবশ্য নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, পরাজয় সুনিশ্চিতÑ এরূপ অনুভূতি ও বক্তব্যে তারা পিছিয়ে ছিলেন না। নির্বাচন কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট না দেওয়া, দলীয় ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে নিষেধ করা, কেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টি, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের ওপর আক্রমণ, বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন না হতে দেওয়াÑ এর সবকিছুই তারা দুপুর ১২টার পর থেকে শুরু করে। যখন প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোট দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে প্রথমে জামায়াত প্রার্থীরা সংখ্যায় প্রায় ২২ জন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। এরপর দুপুর ১২-২টা পর্যন্ত বিএনপি প্রার্থীরাও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তাদের ঘোষণার পরও নির্বাচন সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে হয়েছে এবং সঠিক ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ বলতে যা বোঝা যায় তার সব কিছুই তারা করেছে এবং পরাজয় নিশ্চিত জেনেই তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় এবং ঘোষণা দেয় রায় মানে না, পুনর্নির্বাচন দিতে। সম্প্রতি ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন পুনরায় সরকারের সঙ্গে সংলাপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। কী বিষয়ে সংলাপ করবেন তার ঘোষণা এখনো দেওয়া হয়নি। তবে বুঝতে বাকি নেই তারা যেসব দাবি ইতিপূর্বেই উত্থাপন করেছেন; যার কোনোটাই বর্তমান পর্যায়ে গ্রহণ করা হলে সংবিধানের পরিপন্থি কাজ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্টের সংলাপের সম্মতি দিয়েছেন। তবে তিনিও কিন্তু বলেননি আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে। নির্বাচন পূর্বে যখন সংলাপের কথা উঠেছিল তখন প্রধানমন্ত্রী সংলাপে সম্মতি দেন। নির্বাচনে বিরোধী দল অর্থাৎ ঐক্যফ্রন্ট মাত্র সাতটি আসন পাওয়ায় শেখ হাসিনা যে তুষ্ট নন; তা তার বক্তব্যেই বোঝা যায়। তবে বোধহয় ধারণা ছিল সংসদে বিরোধী দল বেশ কিছু আসন পাবে এং সংসদে একটি বিরোধী শক্তি কাজ করবে। শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে কাজ করতে পারবে। বাস্তবতায় তার প্রতিফলন না ঘটায় প্রধানমন্ত্রী যাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়, তিনি বিরোধী দলকে সক্রিয় করার প্রয়োজন বোধ করেছেন। ড. কামাল হোসেনের সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানানো তাই মনে হয়। প্রচারমাধ্যমে যা দেখা যায়, আ.লীগের সংশ্লিষ্ট নেতারা এবারের সংলাপে বিরূপ মন্তব্য করলেও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র সংরক্ষণের প্রয়োজনেই সংলাপের প্রয়োজন অনুভব করছেন। এ দেশে অনেকে আছেন যারা মনে করেন, শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের পক্ষের কোনো শক্তি নন। তার কারণেই নাকি এ দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটেছে। তাদের উপলব্ধি করা দরকার বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পরও কেন শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে রাজি হলেন। বিশেষ করে নির্বাচিত বিএনপি সদস্যরা যখন শপথ নেওয়া ও সংসদে যোগদান করতে অসম্মতি জানিয়েছেন; তখন সংসদকে কার্যকর করার প্রয়োজনে তাদেরকে সংসদে যোগদান করানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারপ্রধান হিসেবে তার একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব আছে। তার মূল লক্ষ্য সংসদকে শক্তিশালী করা। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সংসদ দুর্বল হয়। এ কথা ঠিক, জাপার ২২ জন সংসদ সদস্য নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তারা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। তাছাড়া আগে জাপা বিরোধী দল হিসেবে থাকলেও তাদের পোষ্য বিরোধী দল বলে অভিহিত করা হতো। তাই বিরোধী দল ও সরকারি দলের অবস্থানরত অংশগ্রহণ করা সত্যিকারে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিল না। এবার অবশ্য জাপার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা এরশাদকে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনে অনুরোধ জানিয়েছেন। তাই আশা করা যায়, সংসদে জাপা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। তাই জাপার ২২ জন এবং ঐক্যফ্রন্টের সাতজন যদি সত্যিকার অর্থে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেন, তাহলে সংসদ সঠিক দায়িত্ব পালনে বেশ কিছুটা সক্ষম হবে। আসলে নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে সংসদ তৈরি হয়। শেখ হাসিনা তার বিজয়ী প্রার্থীদের পদত্যাগ করিয়ে সেই জায়গায় বিরোধী দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করে সংসদকে শক্তিশালী করতে পারেন না। তাই মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাশা করেন যে, বিরোধী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংখ্যায় কম হলেও সরকার যদি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে, তাহলে গণপ্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদ বেশ কিছুটা সঠিক দায়িত্ব পালন করবে।

জাতির জনকের কন্যা, বাংলাদেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দলের নেতা, জননেত্রী শেখ হাসিনা সত্যিকার অর্থেই এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। নির্বাচনে অনিয়মের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে এবং বিরোধী দলের কণ্ঠ তার বিরুদ্ধে সোচ্চার বলে তিনি এবার সংলাপের ক্ষেত্রে নতি স্বীকার করেছেন বলে কেউ চালাবার চেষ্টা করলেও আসল কথা বিগত ১০ বছর উন্নয়ন তৎপরতাকে যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে সক্ষম হলেও উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ঠিকভাবে এগোতে পারেনি। বিগত এক দশক তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল উন্নয়ন ও অগ্রগতি। এবার একই সঙ্গে তিনি গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকেও সফল দেখতে চান। বিরোধী দলের উচিত সংখ্যায় তারা যতই কম হোন না কেন, সম্মিলিতভাবে সাংবিধানিক ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করে চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সবল ও সুষ্ঠু করে তুলবেন। শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য আর তিনি সেভাবেই বিরোধী দলকে দেখতে চান।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close