reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১২ অক্টোবর, ২০২১

আত্মহত্যা কি অপ্রতিরোধ্য?

বর্তমান বিশ্বে জটিল সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি আত্মহত্যা। মানুষের ভারসাম্যহীন মেজাজ আর আশানুরূপ সাফল্য লাভে ব্যর্থতার কারণে বেড়েই চলেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। অতীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মহত্যার ভয়াবহতা লক্ষ করা গেলেও বর্তমানে আমাদের দেশও এ সমস্যার সম্মুখীন। এক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩৯ জন আত্মহত্যা করেন এবং প্রতি বছর আত্মহত্যায় প্রাণ যায় প্রায় ১১-১৪ হাজার মানুষের। এ ছাড়া ২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। তাই এ সমস্যা নিয়ে আর অবহেলার সুযোগ নেই। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সবার সোচ্চার হওয়া দরকার। কারণ আত্মহত্যা হচ্ছে একমাত্র মৃত্যু, যা থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব। আত্মহত্যা সম্পর্কে শিক্ষকদের মতামত তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মুতাসিম বিল্লাহ মাসুম

সবার মতামতের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন

আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি দুঃখের কারণ। আত্মহত্যার প্রথম এবং প্রধান কারণ হিসেবে যে বিষয়টিকে চিহ্নিত করতে পারি তা হলো, যখন একজন ব্যক্তি বেঁচে থাকাকে নিজের কাছে অর্থহীন মনে করে। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তিকে নিজের কাছে অর্থহীন মনে করার পেছনে কয়েকটি বিষয় রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়া। উদাহরণস্বরূপ ভালো চাকরি পেতে ব্যর্থ হওয়া কিংবা বর্তমান সময়ের যুবক-যুবতীদের কাছে বিবেচ্য হলো পছন্দের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে না পারা ইত্যাদি। এ জাতীয় হাজারও প্রত্যাশা মানুষের মনে সর্বদা ঘুরপাক খেতে থাকে। যখন একজন ব্যক্তি তার কোনো আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয় তখন সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং আপনজনকে দুঃখের কথাগুলো বলার চেষ্টা করে। আপনজনদের নিকট থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলে নিজেকে ভীষণ একাকী মনে করতে থাকে। এমন মুহূর্তে নিজেকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য পারিবারিক সচেতনতা প্রধান অবলম্বন। পরিবারের বাবা-মাকে সন্তানের প্রতি বেশি যত্নশীল হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় একই পরিবারের দুটি ছেলে একই বৈশিষ্ট্যের নয়। হয়তো একজন শান্ত স্বভাবের কিন্তু অন্যজন অল্পতে রেগে যায় এবং উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। এক্ষেত্রে অভিভাবককে অবশ্যই তাদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে এবং প্রত্যেকের পছন্দ-অপছন্দের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি সন্তানকে নিয়ে পরিবারের সর্বদা উচ্চ আশা করা ঠিক নয়। লেখাপড়া শেষ করে সন্তানকে চাকরি পেতেই হবে কিংবা পরিবারের পছন্দ করা ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে এমন আকাক্সক্ষা অভিভাবকদের পরিহার করা উচিত। এ ছাড়া সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের সবার উচিত অন্যের দুঃখ-কষ্টের সঙ্গী হওয়া এবং সর্বদা ইতিবাচক চিন্তার পরামর্শ দেওয়া। এভাবেই আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণ মিলতে পারে।

প্রফেসর ড. নুর মোহাম্মদ

চেয়ারম্যান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

আত্মহত্যা নিরসনে মানবিক মূল্যবোধের চর্চা দরকার

আত্মহত্যা বর্তমান বিশ্বের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর নতুন নতুন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে। মূলত আত্মহত্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ব্যক্তির আশানুরূপ প্রাপ্তি লাভে অক্ষমতা, অর্থনৈতিক সফলতার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া কিংবা সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়া। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে ব্যক্তি হতাশ হয়ে পড়ে। যার ফলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা কিংবা নিশ্চিত ব্যর্থতার কথা চিন্তা করে একজন ব্যক্তি নিজেকে সব ক্ষেত্রে অপারগ হিসেবে চিন্তা করতে থাকে, এ পরিস্থিতিকে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলতে পারি, যার চূড়ান্ত পরিণাম হয় আত্মহত্যা। তবে অনেকগুলো কারণের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সফল হতে ব্যর্থ হলে মানুষ অধিক পরিমাণে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ে। অথচ আমরা যেসব ব্যক্তিকে ইতিহাসে সফল হিসেবে আখ্যায়িত করি তাদের অধিকাংশই অর্থনৈতিক সফলতার কথা চিন্তার পরিবর্তে সমাজকে মানবিক গুণাবলির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.), বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা। যারা অর্থনৈতিক সফলতার মাধ্যমে নিজেদের সফলতার চিন্তা করতেন না। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের কাছে সফল ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ, জেফ বেজোস কিংবা অন্য কেউ যে অর্থনৈতিকভাবে সফল। অথচ আমরা এখন আর নৈতিকতার মানদ-ে কোনো কিছু বিচার করার চেষ্টা করি না। যার ফলে সৎ পথে কিংবা অসৎ পথে অর্থ উপার্জনই আমাদের মূল লক্ষ্য। সে আশা পূরণে ব্যর্থ হলে চলে আত্মহননের প্রচেষ্টা। এ সমস্যা সমাজের সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথম পদক্ষেপ শুরু করা উচিত পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। শিশুর সামাজিকীকরণের শুরু থেকে তার মানসপটে মানবিক মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাতে সক্ষম হলে যেকোনো পরিস্থিতিতে হতাশা ও হীনম্মন্যতার বেড়াজাল থেকে মুক্তি সম্ভব। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুণগত শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে, যেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্থনৈতিক সফলতাই সবকিছু হওয়ার পরিবর্তে মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধের সঞ্চার হয়।

ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান

অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি কখনো মুক্তি পাবে না

ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা সম্পূর্ণ হারাম একটি কাজ। মূলত আল্লাহতায়ালা আমাদের জীবন দিয়েছেন এবং তিনি জীবন নেওয়ার মালিক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’ এ আয়াত থেকে বোঝা যায় নিজে নিজেকে ধ্বংস করা কিংবা নিজের শরীরের ওপর অত্যাচার করা ঠিক নয়। এ ছাড়া রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি নিজেকে যেভাবে হত্যা করবে জাহান্নামের ভেতরে সে ব্যক্তি সর্বদা সেভাবে নিজেকে হত্যা করতে থাকবে। আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি কখনো মুক্তি পাবে না এবং অনন্তকাল তাকে জাহান্নামে অবস্থান করতে হবে।’ আত্মহত্যা নামক সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ নানা রকম উপায় অবলম্বন করলেও সবাইকে চিন্তা করে দেখা দরকার, যে সমস্যার জন্য আত্মহত্যা করা হয় মৃত্যুর পর কি সে সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে? কখনো না, বরং নিজেকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। তাই কোনো সমস্যায় পড়লে গভীর রাতে স্রষ্টার কাছে সব সমস্যা বলতে হবে এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে নিজেকে হত্যা করার চিন্তা মন থেকে দূরীভূত হবে। পাশাপাশি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে আমাদের উচিত শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে সমস্যার কথা বলা এবং সমাধানের চেষ্টা করা। সর্বোপরি আত্মহত্যা মহাপাপ, তাই এ পাপ থেকে বিরত থাকতে সকলের চেষ্টা করা উচিত।

ড. মুহা. রফিকুল ইসলাম

সহযোগী অধ্যাপক

আরবি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close