জান্নাতুন নিসা

  ১৫ আগস্ট, ২০২২

শোকের সিঁড়িতে ঢলে পড়েও শক্তির পূর্ণরূপ

বিমূর্ত সময়ের প্রলম্বিত আলেয়ায় বাঁধভাঙা জোছনা মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়; দেখায় আলোকিত এক বিশ্বলোকের স্বপ্ন। এমনি এক স্বপ্নের আলোকিত হাতছানিতে হাজার বছরের শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে শুধু একটিমাত্র অঙ্গুলি হেলনে বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে অঙ্কিত হয় বাঙালি জাতির মুক্তি, স্বাধীনতা,-স্বার্বভৌম ভূখণ্ড, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র, লাল-সবুজ একটি পতাকা। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আনন্দিত হই, উল্লাসে জয়গানে মেতে উঠি- স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে। কিন্তু এ আনন্দ, এ উল্লাস হায়েনাদের ষড়যন্ত্রে প্রবাহিত অগ্নিপ্লাবনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় আমরা হারাই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমাদের জাতির পিতাকে তার পরিবারসহ ৭৫-এর ১৫ আগস্টে নিহত আরো অন্য সবাইকে হারিয়ে আমাদের শুরু হয় পিতৃহীন স্বদেশের পথচলা। সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের বাঙালি জীবনে অঙ্কিত হয় রক্তাক্ত কালিমা। এক দিন যার বজ্রকণ্ঠের আহ্বানে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জেগে ওঠে, জেগে ওঠে বাংলার আকাশ-বাতাস। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাকে হারিয়ে শ্রাবণের শেষ বর্ষণের ধারায় অশ্রুসিক্ত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, নদী, অরণ্য ও প্রকৃতি। সর্বোপরি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ধূলিকণা।

স্বাধীন বাংলাদেশের কোটি মানুষ শুধু অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে, প্রিয় নেতাকে অর্থাৎ জাতির পিতাকে হারিয়ে। কারণ বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতির জন্য অবর্ণনীয় আর নিদারুণ বিয়োগগাথা। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডের শিকার একদিকে যেমন হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার, তেমনি অনেকে। এই ঘৃণ্য ও কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ডে নারী কিংবা শিশু কেউই রেহাই পায়নি। অথচ বর্বরোচিত ভয়ংকর সেই হত্যাকাণ্ডের খুনিদের শাস্তি তো নিশ্চিত হয়নি বরং দীর্ঘ সময় ধরে নানা সুযোগ-সুবিধায় তাদের আড়াল করার অপচেষ্টা হয়েছে। খুনিরা আবার নানাভাবে পুরস্কৃতও হয়েছে। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার ঠেকাতে কুচক্রীমহলের সিদ্ধান্তে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করা হয় সে সময় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের স্বেচ্ছাচারিতায়। স্বাধীনতার পর দেশের ৮০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশের মাটিতে পা রাখেন জাতির পিতা। এরপর ২৬ মার্চ দেশের ব্যাংক, বিমা, পাট, বস্ত্র, চিনি ও জাহাজশিল্পসহ সব ভারীশিল্পকে জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। আমলাতান্ত্রিকতাকে উপড়ে ফেলতে পরিকল্পনা এবং যথোপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করেন জাতির পিতা। কিন্তু বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়কের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত পুঁজিবাদী শোষক গোষ্ঠীর হৃদয়ে আঘাত হানে। তারা ব্যাকুল হয়ে ওঠে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা অঙ্কনে।

বঙ্গবন্ধু তো ছিলেন বাঙালির হাজার বছরের শোষণ-বঞ্চনার শিকল ভেঙে এগিয়ে আসা একজন অগ্নিপুরুষ। যিনি বাঙালি জাতির হাতে তুলে দিয়েছিলেন লাল-সবুজ একটি পতাকা। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দমিয়ে দিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানিরা। তারা থমকে যায় বাঙালির জয় দেখে। অথচ স্বাধীনতার পর খুবই সন্তপর্ণে নিজ দেশি বেইমানরা ষড়যন্ত্রের নীল চাদরে ঢেকে দেয় বাংলার স্বাধীন আকাশ। পাকিস্তান ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আঁতাত করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নীলনকশা করে তারা। মূলত বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতাকে অর্থাৎ বাঙালির এবং বঙ্গবন্ধুর মহৎ ও যুগোপযোগী উদ্যোগকে হত্যা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। অপপ্রয়াস চালায় মুছে ফেলতে, বাঙালির বীরত্বগাথার ইতিহাস। পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত রাজনৈতিক যে সাম্প্রদায়িক ধারা পরাভূত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে, তা যেন আবার পুনর্জন্ম লাভে উজ্জ্বল হয়েছিল পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে কেবল নয়! তার পুরো পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়, যা করতে সাহস দেখায়নি ভিনদেশি হায়েনারাও তা করে দেখিয়েছে এ দেশে অবস্থানরত কুলাঙ্গার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা তো তারা করেছেই সেই সঙ্গে বঙ্গমাতাকেও তারা হত্যা করেছে। অথচ বঙ্গমাতা তো বাংলার চিরায়ত আর মহীয়সী নারীর পূর্ণ প্রতিকৃতিই ছিলেন। তিনি তো শুধু মমতায়পূর্ণ হাতে শাড়ির আঁচলখানি বিছিয়ে দিয়েছিলেন এই বাংলার মুক্তিকামী সন্তানদের জন্য। নিজের সংসারের খরচ থেকে বাঁচানো টাকা থেকে শুরু করে খাবার কি উৎসর্গ করেননি দলের জন্য। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে জেলে নিয়েছে, অত্যাচার করেছে, মৃত্যুভয় দেখিয়েছে অথচ মনে হয় না, তারা বঙ্গমাতাকে হত্যার দুঃসাহসিক বা নির্মম ভাবনাটি কখনো ভেবেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর কি নির্মম ১৫ আগস্টের জঘন্য এই ইতিহাস! শেখ কামাল, জামাল, যারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সুলতানা, রোজী, শেখ ফজলুল হক মণি, আরজু মণিসহ অন্য সবাই এমনকি ছোট্ট রাসেল সোনাকে পর্যন্ত তারা হত্যা করেছে।

সত্যি বলতে কি! বাঙালির জাতিয়তাবোধের চেতনায় উজ্জীবিত প্রগতির জয়যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস চালাতেই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড চালায় হায়েনারা। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তাদের ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের অগ্রগতির চাকাকে থামিয়ে দেওয়া। কারণ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ রুদ্ধ করতে যারপরনাই ব্যর্থ হয় পাকিস্তানিরা। আর তাদের অর্থাৎ পাকি খুনি-ধর্ষকদের দোসর জামায়াত ও তাদের সহযোগী সংগঠন আলবদর, আলশাসম ও রাজকাররা তাতে জ্বলে ওঠে। তাই তো স্বাধীনতার পর থেকেই গোপনে বাংলাদেশকে অস্থির করার জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে তারা। সেই সঙ্গে উগ্রবাদী ও পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর মনোভাব বুঝে এবং তাদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পটভূমি রচনা করে তারা। ফলে আমাদের সামনে আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়ার্ত রাত। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই থামেনি, নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে পর্যন্ত হত্যা করে সেই রাতে। আমরা সবাই জানি, বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলকেও ছাড় দেয়নি এই নরপশুরা।

যুগে যুগে ভাবনার পরতে মননের সাহচর্য এনেছে মানুষ, আর মানুষেরই হাত ধরে পথ হেঁটেছে। রচনা করেছে স্বপ্ন, গেঁথেছে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা বৈশ্বিক সম্পর্কের অমূল্য বন্ধন। যে বন্ধনের হাতছানিতে মানুষ আত্মত্যাগের মিছিলে নেমেছে জীবনের মায়া ছিন্ন করে। তবে ছিন্ন এ মায়ার বাঁধন কখনো কখনো বিদীর্ণকালের বুকে অমলিন হয়ে বেঁচে থাকে ত্যাগের সিঁড়িতে ঢলে পড়েও। তাই তো ১৫ আগস্ট আজ বাঙালি জাতির জন্য শুধু জাতির পিতা এবং সেদিনের শহীদদের কাছে সশ্রদ্ধচিত্তে মাথা নত করার দিন নয়। ১৫ আগস্ট এখন পিতার আদর্শকে গগন মার্গে তুলে ধরে বাস্তবায়নের শপথে এগিয়ে যাওয়ার দিন। ১৫ আগস্টে হায়েনাদের উদ্যত সঙ্গীন আমাদের সুমহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক মুক্তির সোনালি আর গণমুখী পদক্ষেপগুলোকে স্তব্ধ করার হীন উদ্দেশ্যে এগিয়ে এসেছিল। এগিয়ে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূূল্যবোধকে নস্যাৎ করার প্রয়াসে। তারা আঘাত হেনেছিল স্বাধীন বাংলার সমাজ প্রগতির অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার প্রত্যয়ে। অথচ কৃতজ্ঞ বাঙালি আজ আগস্ট এলেই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে জাতির পিতাকে। একটি দিনের শোকাবহ বার্তা মাসব্যাপী শ্রদ্ধা নিবেদনে শোকের পূর্ণ রূপ শক্তিতে রূপান্তরিত করে হায়েনাদের মুখোশ উন্মোচন করে এগিয়ে চলছে প্রজন্মের হাত ধরে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারীনেত্রী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close