নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪

দুর্নীতিরোধই স্বাস্থ্যের বড় চ্যালেঞ্জ

দেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর অন্যতম স্বাস্থ্য খাত। হাইকোর্ট বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত দুর্নীতি রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এক প্রতিবেদনে বলেছে, স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, কেনাকাটা, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি খাতে দুর্নীতি বেশি হয়। এ অবস্থার মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে এ খাতে নতুন মন্ত্রী দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে যিনি দায়িত্ব পেয়েছেন, তিনি অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেছেন, কখনো দুর্নীতি করিনি, দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ও দেব না। ফলে স্বাস্থ্যের দুর্নীতি প্রতিরোধই হবে নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।

একাদশ সংসদে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির কারণে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। নানা অনিয়মে যুক্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম পদত্যাগ করেছিলেন। স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় বারবার দুর্নীতি হচ্ছে। যেমন ভাইরাস ও ছত্রাকের আক্রমণ শনাক্তে রোগীর মস্তিষ্কের রস সংগ্রহে ব্যবহৃত এক সুঁইয়ের প্রতিটির মূল্য ২৫০ টাকা- এ সুঁই প্রতিটি ২৫ হাজার টাকায় কিনেছে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিষ্ঠান রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

অস্ত্রোপচারের সময় চামড়া আটকে রাখার জন্য ব্যবহৃত টিস্যু ফরসেপস। বাজারে এগুলোর দাম ৪০০ টাকা। তা প্রতিটি কেনা হয়েছে ২০ হাজার টাকায়। রোগীর প্রস্রাব ধরে রাখার ইউরিনারি ব্যাগের প্রতিটির বাজারমূল্য ৬০ টাকা, তার প্রতিটি কেনা হয়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। করোনা মহামারির সময় মাস্ক-পিপিই কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ ও হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপনের প্রকল্পে দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।

সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, সরঞ্জাম এবং যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে স্বাস্থ্য খাতে জনসাধারণের জন্য বরাদ্দ সরকারি বাজেট লুটে নেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি থামেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য ইনটিটিউট এবং নার্সিং অধিদপ্তর ছাড়াও প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, স্বাস্থ্য বিভাগীয় অফিস, সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ সব স্বাস্থ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রয়েছেন দুর্নীতি-অনিয়ম সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

করোনাকালে দেখা গেছে, করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার ফলে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ এবং জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার (জেকেজি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল চৌধুরী ও চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফসহ এমন কয়েকজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া জড়িত অন্যরা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির টাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক মো. মালেক ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেনরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়ে তারা জেলে গেলেও অন্য অপরাধীরা পার পেয়েছেন।

এদিকে গত বছর ৯ মে হাইকোর্ট বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত দুর্নীতি রয়েছে। এক রিট আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে চিকিৎসকরা মুনাফা করছেন। হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, সবকিছুরই একটা সীমা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবসময় কেনাকাটার জন্য প্রস্তুত। একমাত্র আল্লাহই জানেন ওই কেনাকাটায় কী থাকে। আপনারা ১৭ কোটি মানুষের টাকা খাচ্ছেন।

বিচারপতি কামরুল কাদের বলেন, এদেশের সন্তান হিসেবে আমরা অনেক কিছুই জানি। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। যা দেখেছি, তা বিদেশের একটি ছোট হাসপাতালের চেয়েও খারাপ। স্বাস্থ্য খাতে সব ধরনের টেন্ডার ও কেনাকাটায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বিতর্কিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর। আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশেও বিপুল সম্পদ রয়েছে মিঠুর। অর্থপাচারের একটি অভিযোগ দুদকের অনুসন্ধানে রয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মিঠু স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি করে অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। দুর্নীতির জেরে পানামা পেপারসে তার নাম উঠেছিল। গত ২০ আগস্ট তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার দুর্নীতির একটি লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে দুদকে। এতে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ব্যাংকের টাকা নামে বেনামে লোপাট, বিদেশে অর্থপাচার, দেশের সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি, এমএসআর সামগ্রী সরবরাহের নামে স্বাস্থ্য খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগে যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে কোন হাসপাতাল থেকে কী পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন, তার ফিরিস্তিও প্রকাশ করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close