শহীদ ইকবাল

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

পথচলতি ধূপের গন্ধ

এ দেশের কবিতা

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগোত্তর পূর্ব-বাংলায় বাংলাদেশের কবিতার বীজ রোপিত হয়। কিন্তু নির্ধারিত সাল-তারিখ দিয়ে তো কবিতা শুরু হয় না, বিচারও হয় না। নির্ধারিত কালখণ্ডেই থাকে এর কারণ। এর ভেতরেই চেতনা গড়ে ওঠে। নির্দিষ্ট কৃষ্টি, আত্মসত্তার প্রকাশ, জাতীয় চেতনার উদ্বোধন-দ্বান্দ্বিক জীবন পরিক্রমারই একটি স্বতঃস্ফূর্ত স্ফটিকস্বচ্ছরূপ। চিরায়ত নৃ-সংস্কৃতির ধারায় তা স্নাত ও ক্রমবর্ধিতও। তা স্থিতি পায় সিক্ত মাটি-হাওয়ার নির্দিষ্ট ভূগোলে। এটির স্থান অস্তিত্বশাসিত পূর্ব-বাংলা তথা বাংলাদেশে। বস্তুত, ত্রিশোত্তর কবিতার অনুসৃত ধারাটিই এই বাংলাদেশের কবিতার ধারা।

২.

পাকিস্তানের জন্য ‘উন্মাদ’ কবিকুল বহাল থাকেন, তদ্রূপ ঐতিহ্যে কবিতা লিখতে থাকেন। অপরদিকে ক্রমশ নিজেদের আত্মপরিচয় আর বাঙালির স্বতন্ত্র চেতনার পথটি অবমুক্ত হতে লাগল, প্রথমত মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দস্তুর পূর্ব-বাংলার মাটির সমন্বয়ী দৃষ্টি স্ফটিক রূপে, এমত সমর্থনটি আসে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে, দ্বিতীয়ত ক্রমশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য নিরসন। ইত্যাকার এর ভেতরে মূল কাব্য ধারাটি অঙ্গীকৃত হয়ে পড়ে এবং নিজেদেরও সমন্বয়ী চেতনার স্বাতন্ত্র্যরূপে নতুন ফুল-পাখি-নদী-নারী আর নক্ষত্রের গানে স্বচিন্তায় সংশ্লিষ্ট হতে থাকে। এখানে চল্লিশ পেরোনো ফুল-প্রকৃতির কবিদের পঞ্চাশে আরো বেশি বিশ্বমাত্রায় আসর জমাতে চাইলেন। তবে তখন থাকে অল্প বয়সের আবেগ, যুক্তিহীনতা, নিরঙ্কুশ দায়বদ্ধতা। ‘নতুন কবিতা’র কবিদের পঙ্ক্তি তার প্রমাণ। তবে পাকিস্তান-আবেগ বা নিজ ধর্মের বিশ্বাস অবসিত হতে সময় লাগে। একপ্রকার ঝুঁকিও। তবে কবিদের প্রারম্ভিক এ পর্বটির উত্তেজনা দেখার মতোই ব্যাপার। তবুও থিতু হওয়ার পথটি তৈরি হয় উজানের বিরুদ্ধে উচ্চারণের ভেতরে। এক্ষেত্রে প্রকৃত কবিতার পথ অর্জনে একদিকে কায়েম হয় ত্রিশোত্তর কবিপ্রভাব এবং সমসাময়িক অন্যান্য সাম্যবাদী কবির অনুপ্রেরণার আবর্ত। আবু হেনা মোস্তফা কামাল যেমনটা বলেন, ‘ক্রম-প্রসারমান মধ্যবিত্তের কর্মজীবনের অন্তরালে যে আবেগণ্ডআকাক্সক্ষা নিহিত ছিল- তারই প্রকাশ ঘটেছিল ওইসব কবিদের রচনায়। আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, জিয়া হায়দার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ফজল শাহাবুদ্দীন- তারা সবাই এই সময়ে কাব্য সাধনা শুরু করেন। তাদের শৈল্পিক সাফল্য অবশ্যই তুল্যমূল্য নয়; কিন্তু সেই কবিকুলের বড় বৈশিষ্ট্য হলো তারা সবাই নতুন মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি এবং সেই সূত্রে দাদের কবিতার ভাষা, ফররুখ আহমদের অনুসরণে, মিশ্র নয়, বিশুদ্ধ বাংলা-রূপক, উপমা, প্রতীকের ব্যবহারে তারা বাংলা কাব্যের অবিভাজ্য ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। প্রায়শ তিরিশের কবিতার সঙ্গে গভীরভাবে লগ্ন। সে কারণে এইসব কবিদের প্রাথমিক রচনায় জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু অথবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব একেবারে আকস্মিক নয়।...’ এক্ষেত্রে পঞ্চাশের কবিদের একটি উল্ল­ম্ফন যুগ রচিত হয়। বাংলাদেশের কবিতা এগোতে থাকে প্রধানত সদ্য চলমান মধ্যবিত্ত বাস্তবতাকে অঙ্গীভূত করে এবং প্রসঙ্গত কবিরাও নিজেদের ভেতরে বদলাতে থাকেন। হয়ে ওঠেন নাগরিক।

পূর্বাপর এমন ঘটনার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের জন্ম হলে বাঙালি মুসলমান ঢাকাকে আশ্রয় করে নতুন স্বপ্ন দেখে। সাম্রাজ্যবাদের মুক্তির লগ্নে, বাঙালি মধ্যবিত্ত বসতি নেয় ধর্ম-ঐক্যের ভেতরে। পরে ঢাকাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় কর্মচাঞ্চল্য। দীর্ঘবঞ্চিত জীবনে উপনিবেশিত বা হিন্দু আধিপত্যের ভেতরে ‘পথহারা পথিক’ যেন পথ খুঁজে পায়। বাঙালির নগর জীবনও তৈরি হয় তখন থেকেই। পুঁজির বিকাশ ও সম্প্রসারণের ব্যাপারটিও তখন ঘটতে থাকে নানাকৌণিক।

গ্রাম ছেড়ে শুরু হয় শহরে আসা। কিন্তু গ্রামীণ রূপসী বাংলার আবেগ থাকে চিত্তে। সবকিছু বুকে নিয়ে নাগরিক বসতি শুরু করেন ভাগ্যসন্ধানী মানুষ। পুঁজির প্রকোপে তারা ছড়াতে থাকেন নিজেদের মতো করে। অভিবাসনও চলতে থাকে। অধিকন্তু পূর্ব-বাংলার চল্লি­শের কবিরা কলকাতা থেকে চলে আসেন ঢাকায়। আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন ‘ত্রয়ী’ এ সময়ের আগেই কবি পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাষার দাবি যত দৃঢ়তর হচ্ছিল ততই ঢাকার গুরুত্ব বাড়ছিল। কবিরাও যেন পাচ্ছিলেন মাটির লালিত্য। প্রসঙ্গত এসব ক্রিয়াকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ওই মধ্যবিত্ত। তাদের বৈশিষ্ট্য কিংবা স্বার্থপরতা পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকরা পূর্ব-বাংলায় তাদের মনোনীত এজেন্ট তৈরি করতে শুরু করেন। তরুণ-কর্মপ্ল­াবী-সাহসী-পরার্থসেবী তরুণদের সামষ্টিক আন্দোলন ঠেকানোর জন্য রাষ্ট্রশক্তির এ অপতৎপরতায় সদ্য স্বাধীন মুসলমানদের অনেকেই স্বার্থভোগী হয়ে ওঠেন। নতুন আবেগের ভেতরে কিছু শ্রেণি বা স্বার্থপর গোষ্ঠী তৈরি হবে- এ আর নতুন কী? শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আলাউদ্দিন আল আজাদ এ সময়ে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাদের কবিতায় থাকে পূর্বসূরিদের মায়া ও কল্পজগতের অবভাস। এ কবিদের হাতে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। কারণ ভাষা আন্দোলনে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বিজয়, মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি, যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ-এসব কবিতার পক্ষে উক্তি ও উপলব্ধিকে তৈরি করে। একটি কবিভাষাও তাদের ক্রমশ আয়ত্তে আসছিল। আর মধ্যবিত্তও একটা সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করছিল। তবে এর বিপরীতে ইসলামপন্থি অংশটিও যে ‘হয়ে ওঠে’ না, তা নয়। তাদের দ্বিধান্বিত স্বরটি ‘পাকিস্তান’ আর ‘কায়েদণ্ডই-আজমে’ আটকানো। তবে তফাৎটা উপযুক্ত অংশের আলোচিত কবিদের কবিতার দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা সম্ভব। তবে সদ্য সচল একটি সমাজে যে সবকিছুই পূর্ণাঙ্গরূপে বিদ্যমান থাকবে, তা সত্য নয়। কারণ সাম্রাজ্যবাদের কোপানলে যে মধ্যবিত্ত তা শুধু অনিবার্য বাঁচার অংশ ও অধিকারটুকু চেয়েছিল, সে যখন স্বাধীন হলো তখন শঙ্কামুক্ত হয়ে ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে উঠল। ঘটল যাবতীয় সীমাবদ্ধতার অবসান। আবেগের যেন মহীরুহ প্রত্যাবর্তন। ‘নতুন কবিতা’ কিংবা ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের লেখকরা শুধু বিষয়বুদ্ধি নয়, বিষয়াতীত বিষয়কেও তারা কবিতায় উপাদানরূপে আনতে চাইলেন। কবিতার মূলধারাটি বজায় রেখে সামষ্টিক প্রবণতায়, সমন্বয়বাদী ভাবনায় শিল্পকে বহুমুখী করে তুলতে চাইলেন এবং বোধকরি পরের দশকে তা পরিপূর্ণরূপে কূলে ফেরার পালা। অবশ্য সে অভিজ্ঞতা এবং এগিয়ে যাওয়া তো ‘কাব্যকে বৃহৎ কাল-চৈতন্যের সমান্তরাল একটি সরল রেখায় বয়ে নিয়ে’ আসার প্রত্যয়।

পঞ্চাশের কবিরা একটা দশকে সীমাবদ্ধ নন। কবিত্ব নির্ণয়েও তাদের প্রারম্ভ ও প্রতিশ্রুতিটি এখানে বজায় থাকে। এ দশক বাংলাদেশের কবিতার প্রারম্ভিক কাল। বাঙালি মুসলমান পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে কাব্যভূমির মৌল সূত্রটি সন্ধান করছে এ দশকে। যারা পঞ্চাশে পৌঁছেছিলেন সে কবিতায় উঠে আসে লোকজ জীবন, অপরিমেয় সম্ভাবনার স্পর্শগন্ধময় আকুতি, ফুল-প্রকৃতির প্রণয় আর পরিশুদ্ধ মূল্যবোধের চর্চার মত্ততা। চেতন-অবচেতনভাবে মনস্তাত্ত্বিক ইঙ্গিতে নির্ধারিত সৃষ্টিসত্তা রূপান্তরিত হয় নদী-প্রকৃতির নিস্পৃহ নৈর্ব্যক্তিক সত্তায়। নদী ও মানুষের কবিতা লেখেন সানাউল হক। লোকায়ত নন্দনে সাত-নরী হার লেখেন আবু জাফর ওবায়দুল্ল­াহ। অনেকেই ফেরেন স্নিগ্ধ মহিমান্বিত উজ্জ্বল জীবনে। সেখানে এক রকমের সংস্কার যে থাকে না তা নয়। কিংবা মানবতার জন্য দায় বা নিরঙ্কুশ আকুতি, নারীর শরীরী প্রণয়, আসঙ্গলিপ্সা, জৈবিক প্রণোদনা এমনসব বিষয়গুলো আড়ষ্ট; কারণ, রোম্যান্টিকতার পূর্ণায়ত রূপটি তখনো তেমন করায়ত্ত হয়নি তাদের নিকট। এ পঞ্চাশে আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ শামসুল হক ক্রমশ অধিকার করছেন জীবনের যাবতীয় ও সূক্ষ্মতর বিষয়সমূহ। কবিতার উপাদানগুলোতে তুলে এনেছেন মানবতার সর্বোচ্চ ক্ষেদ। নাগরিকতার অন্তর্ভুক্তিও পায় কবিতা।

বায়ান্ন থেকে আটান্ন বাংলাদেশের কবিতায় স্ফূর্তি আসে। এরপর বাষট্টি পর্যন্ত বিপর্যস্ত। বাষট্টির পর পূর্ণ প্রবাহ। শামসুর রাহমান পঞ্চাশের গোড়ায় শুরু করলেও প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে বেরোয় ষাটে। প্রায় একই ঘটনা সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান এবং এ পর্বের অন্যদের ক্ষেত্রে। তবে কবিমেধার পূর্ণতা আসে একটা সময়ে। সে সময়কে চিহ্নিত করা একটু মুশকিল। কারণ এ বিচার অনেকটা সাবজেক্টিভ এবং আপেক্ষিক। আহসান হাবীব বা শামসুর রাহমানের মতো অনেকেই কয়েক দশক ধরে কাব্যসাধনা করেছেন। কবিরূপে অনেক পরীক্ষার আবর্ত যেমন তারা অতিক্রম করেছেন তেমনি তাদের প্রতিমায় সাধিত হয়েছে ‘নিকষিত হেম’ সমৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে বিবেচনার জায়গাটিও বিচিত্র। প্রথম কাব্যে শামসুর রাহমান যেভাবে উপস্থিত-রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩) তা পরিবর্তিত। কারণটি নিহিত দেশ-কাল-সমাজ-প্রতিপার্শ্ব চেতনায়। যে দৃশ্যমান জগৎ থেকে কবিচেতনা দিব্যমূর্তি লাভ করে। অবচেতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে জন্ম নেয় যে সত্তাটি-সেখানে অভিজ্ঞতাণ্ডঅন্বেষিত স্মারক প্রস্তুত করেন কবি। স্মর্তব্য, এ সময়টায় সম্পাদিত কবিতা সংকলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন- এসবে যে নতুন মধ্যবিত্ত উঠে আসে তারা অনেকটা পরিশোধিত। অসাম্প্রদায়িকতা বা মানবিক কল্যাণের বিষয়সমূহই তারা সামনে এনেছেন। ধর্মীয় সংস্কার ও জাতপাত-শ্রেণিভেদ তারা অস্বীকার করে। শাশ্বত শিল্পচেতনাকে দেয় প্রাধান্য। এ বিশ্বাস আসে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভের ভেতর দিয়ে। তবে অবাঙালি শ্রেণিশক্তি বা সামন্তগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় ‘অনুগত চর’রা নানাভাবে নিজেদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা চালান। এতে করে দ্বন্দ্বাত্মক আবহ যে রচিত হয় না তা নয়। এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতরেই পূর্ব-বাংলার নব-উত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি সমাজসম্ভূত শিল্পজগৎটি নির্মাণ করতে থাকে। প্রসঙ্গত বহির্দেশীয় সাম্রাজ্যবাদের ভূত যে ওই সামন্ত শাসক বা আমলাদের শক্তি জোগায়নি তা নয়। বরং বিপুল জোয়ারের স্বপ্নকাতর আবেগের ভেতরে রাষ্ট্রের এদেশীয় এজেন্টরা নিজেদের আখেরের লাভ এবং লোভ চিনে নিতে ভুল করে না। কিন্তু এসব অন্তরায় আদর্শ সচেতন নতুন মধ্যবিত্তকে কিছুতেই পরাস্ত করতে পারেনি। বরং লক্ষ করা যায়, বিপরীতমুখী ধর্মীয় চেতনা ধারার কবিরা মø­ান হওয়াই শুধু নয়- ক্রমণ্ডঅপসৃত হতে থাকেন। এ পটভূমিতে সিকান্দার আবু জাফরের (১৯১৯-১৯৭৫) ‘সমকাল’ (১৯৫৭) পত্রিকাকে ঘিরে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিচর্চা আরো বেগবান হয়। তাদের যাত্রা পঞ্চাশের মধ্যভাগে। কিন্তু প্রকরণগত ঔজ্জ্বল্য পরীক্ষা করলে ষাটের প্রথমার্ধেই অনেকটা চকিত। হয়ে উঠেছেন স্থির, বাড়ন্ত।

১৯৫৮-তে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান (১৯০৭-১৯৭৪) পাঞ্জাবি সামরিক সমর্থনে ক্ষমতায় আসেন। এতে এ অঞ্চলের মুসলমানরা বিমূঢ় হয়ে পড়েন। বিভ্রান্তি আর স্থিরতা জন্ম নেয় সমাজস্তরে। উল্লি­খিত মধ্যবিত্ত দ্বন্দ্বের সুযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকভাবে, আইয়ুব অনুগত শ্রেণি তৈরি হবে, তাতে আর সন্দেহ কী! চিরকালই ক্ষমতালোভীর দল, চাটুকারের দল, হালুয়া-রুটির সন্ধানী, উচ্ছিষ্টভোজীরা এমন সুযোগের জন্য প্রস্তুত থাকে। উপনিবেশবাদ অবসানে নতুন রাষ্ট্রে এমন শ্রেণিকাঠামো অনুপস্থিত থাকে না। আর পাকিস্তানের মতো প্রাসাদ ষড়যন্ত্রপুষ্ট রাষ্ট্রে এ সুযোগ আরো বেশি। প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিপতির অনুগত দলবাজ, ফড়িয়া শ্রেণি প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে যায়। আসন্ন ‘মৌলিক গণতন্ত্রে’ (১৯৬২) র নামে দ্বিধাবিভক্তি আর আত্মক্ষয়ের অধ্যায় রচিত হতে থাকে। আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী অংশে ভাগ হয়ে যায়। একজন পশ্চিমা সমর্থক অন্যজন সাম্রাজ্যবাদণ্ডবিরোধী। এরূপ নানামুখী বিভ্রান্তিতে গণসমাজে ডিক্টেটর আইয়ুব খানই ‘হিরো’তে পরিণত হন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক উঠতি মধ্যবিত্ত আত্মমগ্ন ও অন্তর্লীন হয়ে পড়ে। একটা বিচ্ছিন্নতা, বৃত্তায়ন আর বিড়ম্বনা গ্রাস করে। কবিরা তেমন এগোলেন না। কবিতা ‘গ্রহণ-ধরা ছায়ার মতো’; অনালোকিত। তবুও চণ্ড আইয়ুবের বিরুদ্ধে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিক উদযাপন সম্পন্ন হয়। বোধকরি কবিরা এরপর আর অক্রিয় থাকেননি। এ পর্বে একদিকে লোকায়ত এবং নাগরিক চেতনা দুটোই এগোতে থাকে- আর বলতেই হয় কবিভাষার অবলম্বন-বিভাবে জাগরিত ওই ত্রিশের উত্তরাধিকার।

ষাটের প্রারম্ভ থেকেই পূর্ব-বাংলার জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বরূপ উপলব্ধি ও প্রতিক্রিয়ার বোধটির সঙ্গত প্রকাশ ঘটাতে থাকে। এ দশকের প্রথমার্ধের কবিরা মুখোমুখি হন মৌলিক গণতন্ত্র বা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের। নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি হতাশ, বঞ্চিত- যতটা স্পন্দিত ছিলেন ঠিক ততোটাই হলেন মলিন। কবিতায় তখন বাহুল্য হয়ে ওঠে যৌনতা, বিচ্ছেদ, উগ্রতা; কিংবা পরাবাস্তব

(surrealist) চিত্র। শামসুর রাহমান পরিবর্তিত; আল মাহমুদ আধুনিকতার সমস্ত শর্ত বজায় রেখে গ্রামীণ লৌকিক জীবনে ফেরা আর আবদুল মান্নান সৈয়দ পরাবাস্তব প্রকরণে আটকান। তবে এসবের ভেতরে কবিতায় প্রচ্ছন্নভাবে কায়েম হতে থাকে স্বাজাত্য, স্বদেশপ্রেম। সেটা খণ্ডিত, বিচ্ছিন্নভাবে কোনো পঙ্ক্তিতে, কখনো উপমাপ্রতীকে। এগুলো ষাটের প্রথমার্ধে শুরু হলেও স্পষ্টতর দ্বিতীয়ার্ধে। এখানে অধিকারের জানালা খুলে দেয় ‘ছয়দফা’র স্বায়ত্তশাসন- যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যচিন্তা বেগবান। একটু পরিচিতি কবিরা এগালেন, পৌঁছালেন নিজ বাসভূমে, লিখলেন পয়ারে বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা। অদ্যাবধি বাংলাদেশের কবিতার সবচেয়ে প্রজননোচ্ছল সুদিন এ সময়টি। প্রসঙ্গত, তখন কিছুকাল আগে মৃত্যু হয়েছে জীবনানন্দ দাশের (মৃত্যু ১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের (মৃত্যু ১৯৬০); বুদ্ধদেব বসু জীবিত- তিনি করে ফেলেছেন কবি শার্ল বোদলেয়ার ও মারিয়া রিল্কের কবিতার অনুবাদ। বিষ্ণু দে (টি এস এলিয়টের অনুবাদক) কিংবা অমিয় চক্রবর্তী দুর্দাম লিখে চলেছেন। ষাটের প্রান্তিক এ কবিরা এসব থেকে প্রবল বৈশ্বিক হয়ে পড়েন। আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক সুররিয়ালিস্ট, পাশ্চাত্য অনুগত; নির্মলেন্দু গুণ প্রত্যক্ষ, নিরাবরণ, গণমানুষের পক্ষের পদাতিক। আর মহাদেব সাহা রুগ্ন রোম্যান্টিক। রফিক আজাদ চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মর্মদাহনে নির্ণীত। এরা এগিয়েছেন একাত্তরের ভেতর দিয়ে, এ পর্যন্ত।

৩.

কবিতার অপরূপত্ব অনেক রকমের। কবির হাতে অনুভবের অপরিহার্য উচ্চারণটুকু শামিল হয় ভাষার প্রতীকে। এই প্রতীকে বহু-বিস্তর স্বপ্ন প্রতিপাদ্য থাকে। পুরাণ-প্রত্ন অবিনাশী হয়ে ওঠে। ফরাসি মনোবিদ জ্যাক লাঁকা ভাষার সঙ্গে স্বপ্নমাখা জীবনকে মিলিয়ে মনের অন্দর-সদরের, গোপন-উন্মুক্ততার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। মনের কোণের আয়নাকে কোনো ধ্বনি-প্রতীকে বাইরের প্রতিবেশের সঙ্গে সংযোগ করেছেন। আর তাতে আছে সামগ্রিক চেতনার প্রয়াস। যিনি কবি- তার এ চেতনা কারো কারো কাছে ‘অবজেকটিভ কোরিলেটিভ’, কারো কাছে বিপরীতে ‘ইমোটিভ’ বা আবেগোদ্দীপক ভূমিকায় প্রদর্শিত। টি এস এলিয়টের মতে Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the exprision of personality, but an escape from personality. But, ofcourse only those who have personality and emotions know what it means want to escape from these things. আবেগের বিপরীতে নিরাবেগ প্রস্তাবনায় কবি সৃষ্টির প্রত্যয়কে নির্ধারণ করেছেন। কবিতা মন্ময় আবেগের বিপরীতে তন্ময় ও নৈর্ব্যক্তিক বাস্তব প্রেরণাটি গ্রহণ করে, সেজন্য সে শরীরে বহন করে অনেক রহস্যময় প্রতীক, পুরাণ ও মৌহূর্তিক ইমেজ। ইমেজিস্টরাও এই প্রেরণাটি গ্রহণ করেছেন, ‘কঠিন বাস্তব আনার’ প্রত্যয়ে। এক ধরনের প্রত্যক্ষতাও তাতে আছে- যেখানে শব্দ নির্ধারিত, নির্বাচিত এবং ঘনত্বে ব্যঞ্জিত। রক্তিম এবং তাণ্ডবময় দ্বন্দ্বাত্মক জীবনের চিহ্নিত প্রদাহ। এরূপ পঙ্ক্তিমালায় প্রকরণ সম্পর্কে বলা যায়, ‘নিরঙ্কুশ অনিবার্য শব্দ প্রয়োগ করতে হবে; প্রয়োজনবোধে চলতি বাগধারা পরম্পরায় রচনা করতে হবে, ছন্দস্পন্দনের পরম্পরা অনুযায়ী নয়; চিত্রকল্পের বিষয়ে নিবিড় রূপদান...’। বিপরীতে আবেগোদ্দীপক ভাষার পক্ষে আই এ রিচার্ডস তার প্রতিবেশ নিরূপণের ক্ষেত্রে বিষয়-প্রবণতায় ভাষার আবেগী সংশ্লিষ্টতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কল্পসৌন্দর্যই সেখানে মুখ্য। অবচেতন বা নির্জ্ঞানসত্তায় স্বপ্ন তথা যৌনবিহার অহং-রূপটি এক কল্পপ্রতিমার ধারণার জন্ম দেয়। কল্পনা বা আবেগই সেখানে মুখ্য।

একাত্তর-উত্তর কিশোর বয়সি রাষ্ট্রে পুঁজির প্রসার, মানুষের সম্পর্কের বন্ধন বিচিত্র রূপ লাভ করেছে, আয়-ব্যয়ের সীমানা বা সামাজিক মর্যাদা কুশৃঙ্খলে আচ্ছন্ন। সাহিত্য-দর্পণে কিছুই অনালোকিত থাকে না- কিন্তু শিল্প তো তার চিরন্তন পারিপার্শ্বিকতাকে ছাড়িয়ে যায়, রচনা করে উত্তরপ্রজন্মের অনিঃশেষ অবারিত অভিসার। ষাটোত্তর লেখকরা বিস্তর অভিজ্ঞতায় সাহিত্যের আধার আধেয়র চর্চা করেছেন। বিস্তর সময় ব্যবধানে তা একপ্রকার উত্তীর্ণ-অবমুক্ত বলা যায়। যে অভিমুখে পূর্ব-বাংলার সাহিত্যকারদের হাতে সৃজিত হয়েছিল, শেষাবধি সে স্বপ্নকল্পনা ততোধিক হয়ে উঠেছিল- এই স্বাধীন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব তাদের স্বার্থরক্ষায় অনুগত মুৎসুদ্দি শ্রেণি তৈরি করে। আত্মকেন্দ্রিক নেতৃত্ব শিল্পী লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না। অজাচার- ‘অনাহার’ চললেও পরিশুদ্ধি তো চলেই। এখনো অনেক কবি নির্মোহ, নির্লোভ। সত্তর দশকে বিধ্বস্ত, হতাশার মুখে; রচিত ইমেজ- স্রোতের বিপরীতে। ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অপশাসন, অবক্ষিণœতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা লেখেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্ল­াহ। নানা রকমে এ সময়ের কবিরা প্রস্ফুটিত। কেউবা আত্মমগ্ন, অন্তর্লীন; কেউবা অনুকরণপ্রিয় রোম্যান্টিক। একটা স্ববিরোধিতা, দ্বন্দ্ব-দোলাচলতা দেশ-কালসাপেক্ষে চলতে থাকে। এ সময়ের কবিরা একদিকে যেমন উত্তরণের চেষ্টা করেন তেমনি রাজনৈতিক প্রতিবাদে হয়ে ওঠেন স্পষ্টভাষী। নির্মলেন্দু গুণ কিংবা মোহন রায়হান সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে মুক্তমানবতার বিজয়বার্তা ঘোষণা করেন। কবিরা আশাবাদের বাণীই প্রত্যয়দীপ্ত করেন। এ সময় স্বাধীন দেশে অনেকেই মূল্যবোধের ভিত্তিটি তৈরি করেন। প্রধানত মুক্ত স্বদেশে, স্বাধীন এ দশকে, বাঙালির আবেগ হয়ে ওঠে অনিরুদ্ধ। নারী বা শ্যামলী নিসর্গ যোজনা করে নতুন মাত্রার। স্বপ্ন-সম্ভাবনার মূর্তিমান বিন্দুতে থাকে যাবতীয় অস্থিরতার অবসানের আর্তি। কবিরা একটা স্থির ও স্থায়ী প্রকরণ-নির্মাণে পরিশ্রমী হয়ে ওঠেন। ব্যক্তির আনুগত্য, ব্যক্তিবলয় ছাড়িয়ে পৌঁছায় শুভ ইঙ্গিত। সেখানে চিহ্নিত থাকে সময়ের বলিরেখা। এ দশক অনেক প্রলম্বিত, এদেরই অনুবর্তী পরবর্তী দশকের কবিরা। প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে এ শতকের কবিরা নতুন কবিভাষায় যেমন উঠে আসেন তেমনি পূর্বের কবিকুলও অর্জন করেন অপরিহার্য প্রত্যাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের পরে থিতু হওয়া, অভিজ্ঞতা আবেগরহিত, সত্তরের প্রবাহ পৌঁছায় আশিতে। একই ধারায় ও আচরণে, তবে চেতনার শুদ্ধতা পরিপক্ব, বুদ্ধিতে আন্তর্জাতিক অন্তর্ভুক্তি, আরো অধিক নিরীক্ষা, বিজ্ঞানমনস্কতা জারি, বেশি ঢুকে পড়ে স্থূল পারিপার্শ্বিকতা। শুদ্ধশব্দ নির্মিতির চেষ্টায় কৃত্রিমতা নেই তা বলা যাবে না, তবে কৃত্রিমতা একটা পর্যায়ই বলতে হবে এ সময়ে; তবুও আসলেন অনেকেই স্বৈরাচারী শাসনের বিপরীতে, লিটলম্যাগে ভর করে, সব আগ্রাসী শক্তিকে অভয়ে এড়িয়ে- যদিও তা জটিল কিন্তু কবিতার জন্য সবই রপ্ত হতে থাকে। ‘পরাভব-প্রাণ’ কিছুতেই নয়, ততোধিক আবেগঘন প্রাণে বাজল জীবনের বাঁশী। স্বদেশমুখরিত, স্বাধীনতার অনতি পরের আবেগের চেয়ে অনেক স্বতন্ত্র- কিন্তু এগোনোটা, বোধের ব্যাপারটায় আশি পূর্ণাঙ্গ, আর ধারায় তো অবশ্যই অখণ্ড। কবিতা যে সমকাল ও সমাজকেই রাখবে তার ভেতরে- তা তো নয়, সেটা হতেও পারে না। নন্দনকর্ম অবশ্যই পরিবেশ চায়, সেজন্য তার অপেক্ষা ও গুরুত্ব আছে, কিন্তু অনির্বচনীয় বলে যে কথাটা কবিতায় অনিবার্য তা কীভাবে এলো? আশিতে কবিরা পূর্ব-পাঠ, পাঠ-অভিজ্ঞতায় সমাজধর্ম, মনস্তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, প্রত্নদৃষ্টি অর্জন করেন। ঢাকার নাগরিক হিসেবেও অভিজ্ঞ। অশনির বিরুদ্ধে উজানে যেমন চলছেন তেমনি শেকড়েও ফিরে শানিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। এখানে সবচেয়ে বেশি নাগরিক অভিজ্ঞতা। চেতন-অবচেতন বিন্দুটি স্লোগানতাড়িত, সাম্রাজ্যবাদ ফুঁসছে; কবিতা ব্যঙ্গে হাসছে, জীবন নিয়ে যেমন পরীক্ষা, উক্তিতেও পরীক্ষা- নন্দন পরিমণ্ডলটির ভিত্তি এরূপেই নির্ণীত হতে থাকে। প্রজ্ঞাঋদ্ধ প্রতীক প্রতিমা, উপমা-ভাষা, শুদ্ধশব্দ; খিস্তিখেউড়, আঞ্চলিকতা নিয়ে আশির ভিন্ন বাতাবরণ। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্ল­াহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন সামরিক শাসন-কাঠামোর ভেতর-বাহির পটচিত্র অঙ্কন করেন, রূপকথা বা উপকথার অর্থারোপটি তার অনেক কবিতার প্রাণভোমরা। শোয়েব শাদাব কিংবা সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ এখনো এরকম সোনা-রূপার কাঠি বা ‘সমুদ্দুর’ পুরাণে আছেন। তবে তারা জীবিত, এ পর্যায়ে হয়তো এমনটা এখন নিশ্চিত, তারা কবি হিসেবে চলমান। তাদের ভবিষ্যৎ জানা মুশকিল। তবে প্রচ্ছন্ন আশঙ্কা এজন্যই স্বার্থ-অভাব-সংসার-কর্মব্যাপদেশ-ভোগবিলাস সবমিলে ‘অনেক আলোর ঝলকানি’র তো অনেকেই ধরাশায়ী। তবুও যারা কবিজীবী তাদের প্রণাম।

৪.

নব্বই ও শূন্যের দশক বেয়ে এ দেশের সাহিত্য এখন অপরিমেয়। মুক্ত ও মনোপোলার বিশ্ব, তথ্যপ্রযুক্তির প্রবাহ, মানুষে মানুষের সম্পর্ক, ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থার বিচ্ছিন্ন অবসাদ, গূঢ় ও রহস্যের বিচিত্র ফাঁদ সাহিত্যের ভাষাকে পাল্টে দিয়েছে। শ্রেণি-ব্যবস্থায় কর্পোরাল সংস্কৃতি মনুষ্যচেতনাকে প্রবলরূপে শাসন করছে। কবিতা কঠিন, বিজ্ঞাপনের ছায়ায় বন্দি বাজারচলতি দোষে দুষ্ট। এরূপ অভিজ্ঞতায় কবিতা নেই তা বলা যাবে না। ভাষার উৎকর্ষ ঘটেছে, সাহিত্যে বিশ্ব-অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পেরোনো সাহিত্য পূর্ব-বাংলার সেই মুসলিম সংস্কারাশ্রিত সাহিত্যকে এখন তা চ্যালেঞ্জ করতে চায়। পরিবর্তনের সূত্রটুকু তাতেই ধরা পড়ে। নব্বইয়ে কিছু কবিপ্রতিভা এলেও ওই একইরূপে অখণ্ডরই খণ্ড বলতে হবে তাদেরও। তবে পরীক্ষিত কি না সেটা বলা এখনো কঠিন। এ নিরীক্ষার জন্য এখনো সময়ের প্রয়োজন। ধীর অভিজ্ঞতার সন্দর্শনও কাম্য। এখন এই নতুনদের জন্য পরিচর্যার পরিসীমা, কবিদৃষ্টির সামর্থ্য এখনো অপেক্ষমাণ। উত্তর-আধুনিকতা এসেছে অনেকভাবে, কার্যকর যুক্তিটি কিছুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আকর টেক্সট নেই। কবিতায় অনেক আশা-সম্ভাবনা-অনিবার্যতা আসবেই, উপাদান-উপকরণও থাকবে- সেটা তো বাজারী, বহ্বাস্ফোট, মিডিয়া কারবারি হলে চলে না। আর কবিতার মতো শিল্পে তো অসম্ভব। কবিতায় প্রত্যয় ও পরিচর্যা কিংবা মেধা-যুক্তি-আবেগ বললে জীবনানন্দ-সুধীন-বিষ্ণু-বুদ্ধদেব আর একালে আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, আবুবকর সিদ্দিক উদাহরণ তো বটেই। এদের অনুগামী ধারাতেই নতুনরূপে আসেন কবিপ্রজন্ম। তারও অর্জন করে স্বদেশের মাটি-মানুষ-প্রকৃতির গন্ধ। অবশ্যই তাদের সে দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close