মংক্যচিং মারমা, ইবি

  ০৪ এপ্রিল, ২০২৪

পরীক্ষাগারের ক্ষতিকর বর্জ্য লেক ও পুকুরে

কোটি টাকা ব্যয় করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আধুনিক গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছে। এতে বর্জ্য নিষ্কাশনে পরিবেশসম্মত ব্যবস্থা রাখা হয়নি। গবেষণাগারগুলোতে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংকট আছে। নেই বিষাক্ত বর্জ্য নিষ্কাশনের কার্যকর ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা জানেন না বর্জ্যগুলো কি উপায়ে নিষ্কাশন হয়। তারা জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অ্যাসিডগুলো নিউট্রাল করে একটি পাইপ লাইনে ফেলে দেওয়া হয়। সূত্র মতে, এসব বিষাক্ত পদার্থ বিপজ্জনক। রয়েছে মারাত্মক দুর্ঘটনার আশঙ্কা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও প্রযুক্তি অনুষদ ভবনের নিচতলায় অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ল্যাব (পরীক্ষাগার)। প্রতিদিন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা ল্যাবে কাজ করেন। দিনশেষে ল্যাবে বিশাল পরিমাণে অ্যাসিডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য জমা হয়। ল্যাব শেষে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং ল্যাব কর্মকর্তারা বর্জ্যগুলো নিষ্কাশনের জন্য যে নিউট্রাল মেশিনে ফেলে দেয় সেই মেশিনের পাইপলাইনটি ভবনের পাশের ড্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে পাইপ লাইনের মাধ্যমে যে বর্জ্যগুলো ভবন সংশ্লিষ্ট ড্রেনে ফেলা হয় সেগুলো ড্রেনেজ টানেলের মাধ্যমে মিশে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক ও পুকুরের পানিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় গবেষণাগারটি পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান ভবনে অবস্থিত। এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের ১২টি একাডেমিক গবেষণাগার রয়েছে। নির্দিষ্ট শিক্ষা বিষয়ের ওপর গবেষণাগারগুলোতে অ্যাসিটিক অ্যাসিড, অ্যাসিটেলডাহাইড, ক্লোরোফেনন, ন্যাপথল, বেনজামাইড, বেনজইন, ক্লোরোবেনজয়েক, নিট্রোতোলয়েন অ্যাসিডসহ আরো নানা ধরনের ক্ষতিকর অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও বিভাগ ভেদে বিষাক্ত দ্রব্য, সংক্রামক জীবাণু, অগ্নিশিখা, বিস্ফোরক, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, যন্ত্রপাতি নড়াচড়া, উচ্চ তাপমাত্রা, লেজার, শক্তিশালী চৌম্বক শক্তি, উচ্চ ভোল্ট ইত্যাদি ক্ষতিকর পদার্থ ও উপকরণ রয়েছে।

ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী মুসাব শাহরিয়ার বলেন, ল্যাবের কাজ শেষে যে কেমিক্যালগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য নয় তা আমরা ভ্যাসিনে ফেলে দেই। তবে যদি সরাসরি কেমিক্যালগুলো ফেলা হয় তাহলে তা ড্রেনে গিয়ে ক্ষতি করতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সলিড লিকুইড উভয় কেমিক্যালই ওয়াশ করে ফেলা হয় এবং ড্রেনে গিয়েও পানিতে পড়লে কেমিক্যালগুলো আর বিক্রয়যোগ্য থাকে না। আমার মনে হয় না তা ক্ষতি করতে পারে। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. শরীফ মো. আল রেজা বলেন, কেমিক্যালগুলো ড্রেনের মাধ্যমে লেকে চলে যায়। তবে এই অ্যাসিড যখন পানির সঙ্গে মিশে পানিতে যে প্রাণীগুলো থাকে তাদের জন্য ক্ষতিকর। মাটি, পরিবেশের জন্যও।

তিনি বলেন, আমি বাহিরের দেশে দেখেছি গবেষণাগারগুলোর বর্জ্য বা কেমিক্যাল নিষ্কাশনের জন্য নির্দিষ্ট হাউস থাকে। কেমিক্যালগুলো আলাদা লাইন বা ড্রেনের মাধ্যমে এসব হাউসে যায়। পরে বর্জ্য নিষ্কাশনের গাড়ি এসে হাউস থেকে বর্জ্যগুলো নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে আসে।

তিনি আরো বলেন, আমাদের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির বিল্ডিংগুলো ম্যানেজমেন্ট ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে। ভবনগুলোতে কোন জায়গায় কোন বিভাগ উঠবে তাও কোনো নির্দিষ্ট নেই। তখন যদি প্ল্যানে থাকত যে ক্যামিস্ট্রি বিভাগ নিচতলায় থাকবে তখন সে অনুযায়ী রুমগুলো তৈরি করা যেত, ল্যাবগুলোও সে রকম করে ডেকোরেট করা হতো। ল্যাবগুলোর বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য আলাদা লাইন থাকত, হাউস থাকত।

জীব বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ল্যাবের কেমিক্যালগুলো আমরা সাধারণত নিউট্রাল করেই নিষ্কাশন করি এবং এটিই নিয়ম। কারণ কেমিক্যালগুলো পরিবেশের সঙ্গে মিশে গেলে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বলেন, হয়তো কারো জানার অভাব থাকতে পারে বা জুনিয়র যারা দায়িত্বে থাকে তারা জেনে বা না জেনে ড্রেনে ফেলে দিতে পারে তবে নরমালি এমনতো হওয়ার কথা না। আর এগুলো যেহেতু এক্সট্রাভাবে নিজ হাতেই করতে হয় তাই অনেক সময় সময়ের অভাবে শিক্ষার্থীরা বা ইচ্ছার অভাবের কারণে নিউট্রাল না করেই ফেলে দেয়। তবে এসব ঠিক না।

রিসাইকেল করার জন্য তো আবার প্ল্যান লাগে বড় ধরনের বাজেট প্রয়োজন। বিষয়টি এতটা সোজা নয়। একটা জিনিসকে নষ্ট করে আবার রিসাইকেল করে পুনরায় আগের জিনিসে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য বড় সেটআপের প্রয়োজন। এসব সাধারণত বড় বড় জায়গাগুলোতে প্রয়োজন কারণ তাদের প্রচুর পরিমাণে কেমিক্যাল প্রয়োজন। তার রিসাইকেলের মাধ্যমে একই জিনিস বারবার ব্যবহার করে থাকে। রিসাইকেল প্রক্রিয়াটিও অনেক জটিল। বরং নিউট্রাল ফেলে দেওয়া সহজ।

প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, নিষ্কাশনের ব্যবস্থা যদি না থাকে তাহলে এটি খারাপ বিষয়। তবে অ্যাসিডগুলো রিসাইকেল করার কি দরকার? এগুলো কম দামের জিনিস, রিসাইকেলিং করতে গেলে আরো বেশি খরচ হয়ে যাবে। তাই নিষ্কাশনটাই জরুরি।

টেস্ট অফিসার জোহা বলেন, বিষয়গুলো আমাদের জানা নেই, আমাদের কাজ বাইরে যখন কেউ কিছু ফেললে আমরা তা পরিষ্কার করি। বর্জ্যগুলো ড্রেনের মাধ্যমে নিষ্কাশনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো ড্রেনে ফেলা উচিত নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম শরীফ উদ্দীন বলেন, ল্যাবে যে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় সেগুলো খুব বিষাক্ত। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ক্ষতি করতে পারে। তবে বিষয়গুলো প্রতিকারের প্রস্তাবনা আমাদের কাছে এখনো আসেনি।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম এ বিষয়ে বলেন, রাসায়নিক পরীক্ষাগারের বর্জ্য সম্পর্কে আমি জেনেছি। বিষয়টা আমি সংশ্লিষ্টদের জানাবো। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close