এম কবির, টাঙ্গাইল

  ২৯ মার্চ, ২০২৪

টাঙ্গাইলের শাড়ি

ঈদ-নববর্ষ ঘিরে মন্দা কাটার আশা

গরমের কথা মাথায় রেখে এবার শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র্য আর নতুনত্ব * ৪০০ কোটি টাকার শাড়ি ও তাঁতের নানা পোশাক বিক্রির আশা ব্যবসায়ীদের

এবার ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ- এই দুই উৎসব পাশাপাশি থাকায় বেচাকেনা বেশি হবে বলে আশা করছেন টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ব্যবসায়ীরা। এতে দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক মন্দা অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে আশা করছেন তারা। এই দুই উৎসবকে ঘিরে ব্যস্ততা বেড়েছে তাঁতপল্লীতে। দিন-রাত বুননের কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছে কারিগররা। গরমের কথা মাথায় রেখে এবার শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র্য আর নতুনত্ব। ভোর থেকে চলছে মাকু আর শানার ঠোকাঠুকির শব্দ। তাঁতীর হাত ও পায়ের ছন্দে তৈরি হচ্ছে একেকটি নান্দনিক ডিজাইনের শাড়ি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকারি ক্রেতাদের ভিড় এখন তাঁতপল্লীতে। অর্ডার অনুযায়ী শাড়ির জোগান দিতে রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছেন কারিগররা। সেখানকার ব্যবসায়ীরা প্রায় ৪০০ কোটি টাকার শাড়ি ও তাঁতের নানা পোশাক বিক্রির আশা করছেন।

জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, এ বছর ঈদে ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা যা উৎপাদন করেছি তা এরই মধ্যে বাজারে ছেড়ে দিয়েছি। পাইকারি বিক্রিও মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। আমরা আশাবাদী গত বছরের চেয়ে এবার আমাদের বিক্রিটা ভালো হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এজন্য আমরা আশাবাদী বিক্রি ভালো হবে। তিনি আরো বলেন, এ বছর আমাদের রপ্তানিটাও বেশি হয়েছে। এবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৭৫ লাখ পিস শাড়ি রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানিটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। শুধু আমাদের দেশে বাজার দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এই শিল্পটাকে যেন আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি এজন্য সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত দরকার।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, তাঁতীদের আমরা চলমান প্রক্রিয়ায় ঋণ প্রদান করি। প্রণোদানামূলক ঋণ হিসেবে ৫ শতাংশ ঋণ সার্ভিস চার্জে আমরা তাঁতীদের সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা ঋণ দিতে পারি।

জানা যায়, সুতি শাড়ি ৬০০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, জামদানি, হাফ সিল্ক, মসলিন, এন্ডি সিল্ক ও সফট সিল্ক ১ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে।

টাঙ্গাইলের শাড়ির রাজধানী দেলদুয়ারের পাথরাইল এলাকার তাঁতশিল্পের মালিক গোবিন্দ সূত্রধর বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। পাওয়ার লুমের কারণে হ্যান্ড লুমের তৈরি শাড়ি কম চলে। হ্যান্ড লুমের শাড়ির দাম বেশি। এগুলো এখন খুব কম চলে। ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় পাওয়ার লুমের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। হ্যান্ড লুমের শাড়ি তৈরি করতেই মজুরি দিতে হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। এজন্য আমাদের শাড়ি কম চলে। তারপরও আশা করছি এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ মিলে ভালো বিক্রি হবে।’ গতবারের থেকে এবার বেশি বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি।

পাথরাইলের নলশোধা এলাকার তাঁত শ্রমিক আরজু মিয়া বলেন, একটা শাড়ি তৈরিতে অন্তত দুই দিন সময় লাগে। আমরা বর্তমানে পৌনে ৭০০ টাকা মজুরি পাচ্ছি। এ দিয়ে আর সংসার চলে না। এ পেশা যে ছেড়ে দিব অন্য কাজও পারি না। পেটের তাগিদে এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছি। মহাজনে ঠিকমতো কাপড় বিক্রি করতে পারলে আমাদের কাজ দেয়। আর বিক্রি করতে না পারলে আমাদের কাজ দেয় না।

পাথরাইলে তাঁতশ্রমিক রাসু দেব বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রায় ৩০০ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করেছেন। তারা সবাই তাঁত পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। আমি প্রায় ৪৮ বছর ধরে তাঁতের সঙ্গে আছি। বর্তমানে যে মজুরি পাই তা দিয়ে আমাদের চলে না। আশা করছি ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে তাঁতের শাড়ি ভালো বিক্রি হবে।

নলশোধা এলকার মনির হোসেন বলেন, এ পেশায় কাজ করি ৪০ বছর ধরে। আমার পূর্বপুরুষরা ছিল ২০০ বছর ধরে। তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের শাড়ি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি হয়। একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। বিক্রি হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। মজুরি দেয় মাত্র এক হাজার টাকা। ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের কষ্টে চলতে হয়। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে চলে গেছেন। আমি অন্য কোনো কাজ শিখি হয়নি বলে যেতে পারি না।

ঢাকা থেকে শাড়ি কিনতে এসেছেন রাবিয়া খাতুন। তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কোয়ালিটি ভালো। গতবারের তুলনায় এবার দাম কিছুটা বেশি। তারপরও ভালো মানের বলে নিয়ে যাচ্ছি। ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় তাঁতের শাড়ি পাওয়া গেলেও যেখানে শাড়ি তৈরি হয় সেখান থেকে কেনার মজাই আলাদা।

আরেক ক্রেতা সুমাইয়া শিমু বলেন, ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দুটি তাঁতের শাড়ি নিয়ে গেলাম ও পরিবারের জন্য তিনটি নিয়েছি। শাড়ির মান ও ডিজাইন অনেক ভালো। প্রতি বছর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কিনতে এখানে আসি। আগের থেকে এবার দাম বেশি রাখছে।

টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক পলাশ চন্দ্র বসাক বলেন, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি এবার নতুনত্ব এসেছে। বর্তমান বাজার অনুযায়ী প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হবে বলে আশা করছি। এবার মোটামুটি সবাই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close