মো. মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)

  ২৯ মার্চ, ২০২৪

চোরাচালানির দৌরাত্ম্য

মালামাল ও যাত্রী পরিবহন থেকে যাশোরের বেনাপোল স্টেশন থেকে বছরে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকা আয় হয়। এই স্টেশন দিয়েই ভারতমুখী ট্রেনগুলো চলাচল আছে। স্টেশনটি নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাড়ছে না এর সুযোগ-সুবিধা, বিপরীতে বাড়ছে যাত্রী হয়রানি, বিড়ম্বনা। এখনো চলছে সেই সনাতন পদ্ধতিতে। স্টেশনে লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা এর নিত্যসঙ্গী। স্টেশনের ছাউনি পুরোনো, অনেক জায়গায় ফুটো, সেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। এছাড়া বৃষ্টিতে প্ল্যাটফরমে পানি জমে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়তে হয় যাত্রী সাধারণের। এছাড়া রয়েছে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য।

বেনাপোল রেলস্টেশনে চলছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কার্যক্রম, গণশৌচাগারের অভাব, যাত্রী বিশ্রামাগার অপরিচ্ছন্ন, বিদ্যুৎ চলে গেলে ভূতুড়ে এলাকায় পরিণত, টোপলাটানা পাটির উপদ্রপ, বিশুদ্ধ পানির অভাব, এছাড়া গরু ছাগলের বিরানভূমি এ স্টেশন মাঠ এলাকা।

যাত্রীদের অভিযোগ এখানে উন্নতমানের গণশৌচাগার না থাকায় মহিলা যাত্রীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এখানে একটি প্রথম শ্রেণির ওয়েটিং রুম নেই। একজন সুইপার কাগজ-কলমে থাকলেও তাদের কাজে দেখা যায় না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই, খাবার পানির জন্য একটি টিউবওয়েল ছিল তা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রেলওয়ে স্টেশনে মেডিকেলের কোনো কার্যক্রম নেই। ফলে ট্রেনে কাটা রোগী, সাধারণ যাত্রী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়াও রেলস্টেশনের প্রবেশ মুখে ও এ সড়কে যততত্র ইজিবাইক এবং ভ্যান রেখে প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাধারণ যাত্রীরা এদের অত্যাচারে হাঁটতেও পারে না।

স্থানীয়রা জানান, বর্ষা মৌসুমে স্টেশনের প্রথম প্ল্যাটফরমের চাল দিয়ে বৃষ্টি পড়ে। এতে যাত্রীরা দুর্ভোগ পড়েন। হাঁটু সমান পানি জমে থাকে দেখার কেউ নেই, যাত্রীরা হাঁটতে পারে না, জুতা স্যান্ডেল হাতে নিয়ে ট্রেনে উঠতে হয়। অধিকাংশ যাত্রীরা বিনা টিকিটে ভ্রমণ করে। ভারতীয় পণ্য চোরাচালানি হয় এসব ট্রেনে। ট্রেনের বসার সিট চোরাচালানি পণ্য রাখা হয়। এক শ্রেণির মহিলা চোরাচালানিদের নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে এসব ট্রেন। প্রতিবাদ করলে চোরাচালানিরা একজোট হয়ে যাত্রীদের ওপর মারমুখী হয়ে ওঠে। চক্ষু লজ্জার ও মান সম্মানের ভয়ে কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করার সাহস পান না।

রেল পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী থাকলেও তাদের দেখা যায় প্রকাশ্যে চোরাচালানিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের সহযোগিতা করতে। ট্রেনের মধ্যে রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) থাকলেও তারা একটি বগিতে সিট নিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে আসলেও যাওয়ার সময় চোরাচালানিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে দেখা যায়।

বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের (বেনাপোল-ঢাকা) অপেক্ষমাণ যাত্রী সিদ্দিকুর রহমান জানান, আমি ঢাকা যাব অনলাইনে টিকিট কাটতে হবে। সব সময় অনলাইনে টিকিট পাওয়া যায় না। সমস্যায় পড়তে হয়। বগি বৃদ্ধি করলে এ সমস্যা থাকবে না। সেই সঙ্গে রয়েছে নেশাখোরদের উৎপাত। শুধু তাই নয় বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে স্টেশন যাত্রীদের মূল্যবান কাগজপত্র নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে।

বেনাপোলের যাত্রী আনোয়ারুল ইসলাম জানান, চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, স্টেশনে বিজিবি যখন অভিযানে আসে, তখন চোরাকারবারিরা অবৈধ মালামাল নিয়ে রীতিমতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। জিআরপি পুলিশ সাধারণ লোকজনকে নিরাপত্তা না দিয়ে চোরাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা কালেকশনে ব্যস্ত থাকেন। রেলের যাত্রী নিরাপত্তা ও চোরকারবারিদের প্রতিরোধের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব রেল পুলিশের। রেল পুলিশ এসব দায়দায়িত্ব পালন না করে বরং চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। যে কারণে আজ সাধারণ যাত্রীরা ট্রেন ভ্রমণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর হলে চোরকারবারিদের তৎপরতা কমবে বলে তিনি জানান।

বেনাপোল রেল ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই নজরুল ইসলাম বলেন, রেল যাত্রীসেবা বাড়াতে ও চোরাচালানিদের প্রতিরোধ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে। মাইকিং করে চোরাচালানিদের পণ্য না ওঠানোর জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়। মহিলাদের মালামাল আটক করলেও তারা হাত পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে। বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হয়। রেলস্টেশনে নেশাখোর ও বহিরাগতদের রুখতে পরবর্তীতে আরো কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।

বেনাপোল রেলস্টেশনের মাস্টার মো. সাইদুজ্জামান জানান, গত অর্থবছরে স্টেশন থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা আয় হয়েছে। শুধু গত বছরে নয় প্রতি অর্থবছরে এ স্টেশন থেকে সরকার আয় করেছে কোটি টাকার ওপরে। রেলস্টেশন উন্নয়নে কাজ চলমান। স্টেশনের সমস্যাগুলো কর্তৃপক্ষকে জানান হয়েছে বলে জানান তিনি।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের আগ পর্যন্তও ভারতের সঙ্গে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ চালু ছিল। যুদ্ধকালীন ওই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করে কিছু দিনের জন্য এই পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবারও চালু হয়। কিন্তু ১৯৭৪ সালে লোকসানের কবলে পড়ে রেল চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বেনাপোল যশোরসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ পুনরায় রেলপথটি চালু করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বেনাপোল-খুলনা ভায়া যশোরের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করে। ১৯৯৯ সালে বেনাপোল দিয়ে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ট্রেনে আমদানি বাণিজ্য শুরু হয়। এরপর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুদেশের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর গত ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল পরীক্ষামূলক চালু করা হয় কলকাতাণ্ডখুলনা ভায়া বেনাপোলের মধ্যে ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ নামের যাত্রীবাহী ট্রেনটি। পরে একই সালের ১৬ নভেম্বর থেকে কলকাতাণ্ডখুলনার মধ্যে যাত্রীবাহী ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ভারতগামী যাত্রীসহ এই অঞ্চলের যাত্রীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেনাপোল-ঢাকা রুটে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্বোধন করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close