নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৩ জানুয়ারি, ২০২২

বন্ধুত্বের ফাঁদে প্রতারণা চক্রের ৯ সদস্য গ্রেপ্তার

ভ্রমণ ভিসায় নাইজেরিয়া ও আফ্রিকান থেকে বাংলাদেশে এসে গার্মেন্ট ব্যবসার আড়ালে একটি আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র গড়ে তোলেন বিদেশি নাগরিকরা। এই চক্রে কয়েকজন দেশি প্রতারকদের সহযোগিতায় অভিনব কায়দায় হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা প্রথমে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো কিংবা ফেসবুকে নিজেদের পশ্চিমা দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর তারা দামি উপহার, পার্সেল, অতি মূল্যবান সামগ্রী দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করত। সুনির্দিষ্ট এমন একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে সাত বিদেশি নাগরিকসহ সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।

গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।

মোজাম্মেল হক বলেন, আন্তর্জাতিক এই প্রতারক চক্র গ্রেপ্তারের আগে টাকা ডলারে রূপান্তরিতকরণ ও পার্সেলের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মাদকদ্রব্যসহ ১৫-২০ জন বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৪। ঠিক একই কায়দায় বিদেশি প্রতারকরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে দামি উপহার পাঠানোর প্রলোভনে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ এ চক্র। সুনির্দিষ্ট এমন অভিযোগ ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে বুধবার সকাল ৭টা পর্যন্ত ধারাবাহিক অভিযানে র‌্যাব-৪-এর একটি দল ও র‌্যাব-৮-এর সহযোগিতায় রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় থেকে ৭ বিদেশি নাগরিকসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৮টি পাসপোর্ট, ৩১টি মোবাইল, ৩টি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, ৩টি পেনড্রাইভ ও ৯৫ লাখ ৮১৫ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।

গ্রেপ্তাররা হলো নাইজেরিয়ান উদেজে ওবিন্না রুবেন (৪২), ইফুন্যা ভিভিয়ান নাবুইকে (৩১), সানডে শেডেরাক এজিম (৩২), চিনেদু মোসেস নাজি (৩৬), কলিমস ইফেসিনাছি তালিকে (৩০), চিদিম্মা এবেলে আইলোফো (২৬) ও দক্ষিণ আফ্রিকার এনটোম্বিখোনা গেবুজা (৩৬) এবং দেশীয় দুজন হলেন ফেনীর মো. নাহিদুল ইসলাম (৩০) ও নরসিংদীর সোনিয়া আক্তার (৩৩)।

গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিরা র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকে নিজেদের পশ্চিমা দেশের নাগরিক পরিচয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। একপর্যায়ে দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার জাল ছড়ায়।

টার্গেট নির্ধারণ

প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন প্রোফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে বড় বড় ব্যবসায়ী, হাই-প্রোফাইল চাকরিজীবীসহ উচ্চবিত্ত মানুষদের টার্গেট করত।

শিকার নির্ধারণের পর তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। টার্গেটের কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিত। এরপর বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করত। সম্পর্কের একপর্যায়ে বিভিন্নভাবে টার্গেটকে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রলুব্ধ করত।

র‌্যাব-৪ অধিনায়ক জানান, প্রতারকরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর টার্গেটদের বলত, তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে কিন্তু তারা এসব মুদ্রা খরচ বা নিজেদের দেশে নিতে পারছে না। প্রতারকরা টার্গেটদের বলত, এসব ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা তোমার কাছে রেখে দাও, পরে আমি নেব। চাকরিজীবীদের বলত, তাদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে এবং এতে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবেন। আর যারা ব্যবসায়ী তাদের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ে অর্থলগ্নি করে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ কমিশনের প্রলোভন দেওয়া হতো। এতে সহজ-সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাদের ফাঁদে ধরা দিত।

এরপর প্রতারকরা টার্গেট করাদের ঠিকানায় ছোট ছোট উপহার পাঠাত। এর মাধ্যমে তাদের আরো প্রলুব্ধ করা হতো। উপহার পেয়ে শিকারিরা বিশ্বাস স্থাপন করে। একপর্যায়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলত, আমি তোমার নামে একটি দামি পার্সেল পাঠিয়ে দিয়েছি।

পার্সেল পাঠানোর কিছুদিন পর তাদের এ দেশের নারী সহযোগী বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলত, তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরে পরিশোধ করতে হবে। যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে এবং এভাবে বিদেশ থেকে কোনো পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয়, তাই চার্জ একটু বেশি দিতে হবে। নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদের মামলার ভয়ভীতি দেখানো হতো। নানা প্রলোভন ও মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিত তারা। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে এই প্রতারক চক্রটি।

মোজাম্মেল হক বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে ঢাকার পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করে গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করে। গার্মেন্ট ব্যবসার আড়ালে তারা বাংলাদেশি সহযোগীদের নিয়ে এই অভিনব প্রতারণা করত। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ এবং গ্রেপ্তার হওয়া দুজনের নামে আগের মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার হওয়া সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের দেশীয় সহযোগী। মূলত তাদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভিকটিম সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস অফিসার পরিচয় দেওয়া এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করত।

গ্রেপ্তার নাইজেরিয়ান উদেজে ওবিন্না রুবেন ২০১৭ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসে এবং ২০২০ সালে তার নামে র‌্যাব-৪ কর্তৃক প্রতারণার মামলা হওয়ায় তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। সে নিজেকে একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তার মূল পেশা। সে এই আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের প্রধান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close