এস এইচ এম তরিকুল, রাজশাহী

  ০৪ নভেম্বর, ২০১৮

কোন্দল মেটাতে ব্যর্থ দারা নাদিমের বিকল্প শিমুল

রাজনীতির মারপ্যাঁচে বলা হয়, রাজশাহীর সবচেয়ে জটিল আসন রাজশাহী-৫। জেলার পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলার দুটি পৌরসভা এবং ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে এই আসন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা। স্বতন্ত্র প্রার্থী ঠেকাতে ৯ম সংসদ নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগ থেকে দুজনকে নৌকার টিকিট দেওয়া হয়েছিল। পরে সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ফারুকের মনোনয়নপত্র বাতিল করে কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারাকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে বহাল রাখা হয়। টানা ১০ বছর এমপি থাকলেও তিনি দলীয় কোন্দল মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবি দলটিরই নেতাদের। এবার একাদশ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে চলছে গৃহদাহ। প্রতিটি দলে মাঠে আছেন এক ডজনেরও বেশি প্রভাবশালী নেতা। আছে জাতীয় পার্টিও।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকেই বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুল ওয়াদুদ দারার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে নিজের পক্ষে ভোটা চাইছেন। এদিকে দুবারের এমপি বিএনপির প্রভাবশালী নেতা নাদিম মোস্তফার বিরুদ্ধেও দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

নির্বাচনী ইতিহাস বলছে, স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হন আওয়ামী লীগ নেতা শাহ মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ। এরপর পঞ্চম নির্বাচনী ফলাফলে বিএনপি সরকার গঠন করলেও এ আসন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ পর্যন্ত সব মিলে চারবার এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা।

এর পরও এখানে বিএনপির অবস্থান বেশ শক্ত। দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে এমপি হন জেলা বিএনপির বর্তমান সহসভাপতি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার মন্ডল। তবে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান সাড়ে ৩১ বছর বয়সের তরুণ যুবদল নেতা এবং পরবর্তীতে জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাদিম মোস্তফা। অষ্টম সংসদেও তিনি এমপি নির্বাচিত হন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক থাকায় টানা ১০ বছর সংসদ সদস্য থেকে এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে তার। তবে মামলাজনিত কারণে তিনি নবম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। আসন্ন নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

এ ছাড়াও তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রয়াত মুহাম্মদ আয়েন উদ্দীন। আর জাতীয় পার্টির অধ্যাপক আবুল হোসেন এমপি হয়েছিলেন চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে। তবে নানা সমীকরণে এখানে জয়ের সম্ভাবনা প্রায় নেই। কিন্তু এলাকায় প্রচার আছে সারা দেশের মধ্যে যে কয়েকটি আসন পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দাবি করেছেন, তার মধ্যে রাজশাহী-৫ অন্যতম। তাই এ আসনটিতে মহাজোটের প্রার্থী দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। অধ্যাপক আবুল হোসেনকে এরই মধ্যে সবুজ সংকেত দিয়েছেন তিনি।

একাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে দুই দলের নবীন-প্রবীণ মিলে এক ডজনেরও বেশি নেতা মনোনয়নের আশায় মাঠে নেমেছেন। এখানে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চান ১০ জন। এদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ঠান্ডু, সাবেক এমপি তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক মাসুদ, জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ওবাইদুর রহমান, বাংলাদেশ অটোরাইস মিলস্্ অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সমন্বয়ক আসিফ ইবনে আলম তিতাস, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও দলের জেলা শাখার স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মুনসুর রহমান ও জেলা শাখার সহসভাপতি আব্দুল মজিদ, জেলা যুব-মহিলা লীগের সভাপতি অধ্যাপিকা নারগিস সুলতানা শেলী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবু সায়েম।

তবে সংসদ সদস্য হিসেবে আব্দুল ওয়াদুদ দারার বিতর্কিত কর্মকান্ডের অভিযোগ তুলে এক ব্যানারে এসে অনুষ্ঠান করেছেন আওয়ামী লীগের অন্যান্য মনোনয়নপ্রত্যাশী। বর্তমান সংসদ সদস্য ছাড়া এসব নেতার মধ্যে যে কাউকে দলীয় মনোনয়ন দিলে একসঙ্গে কাজ করার ও জনসভার মাধ্যমে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তারা। তবে এমপি দারা তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে অনেক নেতা আছে। সবাই যে যার মতো করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। তবে এলাকার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে, জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে আমাকেই নির্বাচিত করবে।’

তবে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল মজিদ দাবি করে বলেন, ‘সংসদ সদস্য দারার সঙ্গে কোনো নেতাকর্মী নেই। পুঠিয়া ও দুর্গাপুরের মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। দুবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও একবার উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছি। আশা করছি দল আমাকেই মনোনয়ন দেবে।’

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার হয়েই আমরা কাজ করব। তবে দারার কারণে পুঠিয়া-দুর্গাপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আজ দ্বিধাবিভক্ত। এ অবস্থায় দল যদি আমাকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়, তাহলে অবশ্যই জয়ী হব বলে বিশ্বাস রাখি।’

নিজের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরে আহসান-উল-হক মাসুদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তৎকালীন জামায়াত-শিবির কর্তৃক বারবার হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছি, বিভিন্ন মেয়াদে ছয়বার কারাভোগ করেছি। যে কারণেই তৃণমূলের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে মনোনয়ন দেওয়া হলে প্রথমেই আমার নাম উঠে আসবে। মনোনয়ন দিলে সবাই একযোগে মাঠে কাজ করবে বলেও বিশ্বাস করি।’

অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী ওবাইদুর রহমান প্রতিদিনেরে সংবাদকে বলেন, ‘গত সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে নির্বাচন না হওয়ায় টিকিট পাইনি। দীর্ঘদিন ধরে মাঠে রয়েছি।’

এখানকার ‘উন্নয়নের রূপকার’খ্যাত সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা। তিনি ছাড়াও বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে আছেন আরো পাঁচজন। তারা হলেনÑ পুঠিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মন্ডল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা আবু বকর সিদ্দিক, পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ব্যবসায়ী ইসফা খায়রুল হক শিমুল, দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম সাকলাইন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল কেদ্রীয় সদস্য সিরাজুল করিম সনু।

সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক জেলা সভাপতি নাদিম মোস্তফা বলেন, ‘আমি পুঠিয়া-দুর্গাপুরবাসীর জন্য যা করে দিয়েছে তা ১০০ বছরেও অন্য কোনো এমপি করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি এলাকায় গেলেই বর্তমান সরকারের প্রতিনিধিরা ১৪৪ ধারা জারি করে। আমার নামে ৩০টির অধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে তৃণমূলে আমার জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে। বিএনপি নির্বাচনে গেলে এখানে দল থেকে একমাত্র মনোনয়নের দাবিদার আমি।’

বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী নজরুল ইসলাম মন্ডল বলেন, ‘২০০৮ সালে যখন সবাই পলাতক, তখন আমি নেতাকর্মীদের পাশে থেকে নির্বাচন করেছি। তবে সামান্য ভোটে পরাজিত হয়েছিলাম। সেই থেকে জনগণের সঙ্গেই আছি। এবারও দল আমার প্রতি আস্থা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। ’

দলের নেতাদের ভাষ্য মোতাবেক, নাদিম মোস্তফার নিষ্ক্রিয়তার ফলে দুই উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা বেশির ভাগ মামলার আসামিদের দেখভাল করছেন তরুণ ব্যবসায়ী পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ইসফা খায়রুল হক শিমুল। প্রতিদিনের সংবাদকে তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে রয়েছি। মনোনয়ন না পেলেও তাদের পাশে থাকব। তবে আমি মনোনয়ন পেলে এই আসন পুনরুদ্ধার করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।’

বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী গোলাম সাকলায়েন বলেন, ‘আমার প্রতি সাধারণ মানুষের অগাধ আস্থা রয়েছে। আমাকে মনোনয়ন দিলে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পারব।’ আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী আবু বকর সিদ্দিক (বর্তমানে কারাগারে) প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলাম। বিভিন্ন সময় আমাকে বিরোধীদের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। আসনটিতে দল আমাকে মনোনয়ন দিলে আশা করি বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারব।’

নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ১ হাজার ৬১৪ জন। এর মধ্যে পুঠিয়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার ১৯৬ জন এবং দুর্গাপুরে ১ লাখ ৫১ হাজার ৪১৮ জন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close