তানিউল করিম জীম

  ০২ জানুয়ারি, ২০২৩

বেড়ানো

পাহাড়, সমুদ্রে বাকৃবির বন্ধুরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর থেকেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সব শিক্ষার্থীর কাছে একটি পরিচিত শব্দ এক্সকারশন ট্যুর। প্রতিটি অনুষদের শিক্ষার্থীদের শেষ বর্ষে এই ট্যুরটি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই সিনিয়র ভাই-আপুরা সেই ট্যুরের কথা বলে থাকে। সাত দিনের এই ট্যুরে থাকে পাহাড়, সমুদ্র দেখার পাশাপাশি আনন্দঘন যত মুহূর্ত। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের এই এক্সকারশন ট্যুর শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর।

ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যালিপ্যাড থেকে সাজেকের উদ্দেশে রওনা হয় ওই অনুষদের ৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ৪ জন শিক্ষক। বাসের মধ্যে নাচণ্ডগানে শুরু হয় ট্যুরের যাত্রা। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা যাত্রা শেষে আমরা খাগড়াছড়িতে পৌঁছাই সকাল ৭টায়। ওখান থেকে নাশতা করে চাঁন্দের গাড়িতে করে আবারও রওনা হই সাজেকের উদ্দেশে। এবার শুরু হয় পাহাড়ের উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা রাস্তায় পথচলা। পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা সাড়ে ১২টার দিকে সাজেকে পৌঁছাই। কাঠের তৈরি কটেজে ওঠে সবাই যার যার গোসল শেষে দুপুরের খাওয়া শেষ করে। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে রওনা হই কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশে। কংলাক পাহাড় বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে অবস্থিত। এটি সাজেক ভ্যালির সর্বোচ্চ চূড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফুট। কংলাক পাহাড় থেকে লুসাই পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। চারদিকে পাহাড়, সবুজ আর মেঘের অকৃত্রিম মিতালী চোখে পড়ে। সাজেক ভ্রমণরত পর্যটকদের কাছে এটি এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রুইলুইপাড়া থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরত্বে এটি অবস্থিত। সাজেকের হ্যালিপ্যাড হতে ৩০-৪০ মিনিট ট্রেকিং করে কংলাকপাড়ায় যেতে হয়।

সন্ধ্যার আগে কংলাক পাহাড়ে সবাই ভিড় জমায় মেঘ এবং সবুজের মাঝে সূর্যাস্ত দেখার জন্যে। রক্তিম সূর্য কীভাবে ডুবে যায় ১৮০০ ফুট ওপর দেখে অবলোকন করি সবাই মিলে। এরপর সবাই আবার কটেজের উদ্দেশে চলে আসে। রাস্তায় থাকা বাঁশের চা, মম, কাঁকড়া ইত্যাদি খাওয়া-দাওয়া করে অনেকে। এরপর হ্যালিপ্যাডে বসে আড্ডায় বসে সবাই মিলে। কিছুক্ষণ পর সবাই সাজেকের দোকানগুলোতে ভিড় জমায় পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনতে। রাতে খাবার পর পাহাড়ে বসে শুরু হয় গানের আসর। একদল শিক্ষার্থী ভোর বেলা ওঠে সাজেকের পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখার জন্যে। পাহাড়ের চারপাশে তখন ঘন কুয়াশা। সবুজের মাঝে সাদা কুয়াশা আর রক্তিম সূর্য, সেই সৌন্দর্য শুধু সাজেকেই দেখতে পাওয়া যায়। অপরূপ সেই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে বিমোহিত হন শিক্ষার্থীরা। এরপর সবাই দেখতে চলে যাই ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রামে। যেখানে লুসাইদের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র রয়েছে। আছে তাদের জীবনযাপনের নানা উপকারণ। অনেকে আবার লুসাইদের পোশাকে সেজেছিলেন লুসাই কন্যা। এরপর সকালের নাশতা শেষে রওনা হয় কক্সবাজার সমুদ্র দেখতে। মাঝ পথে আলুটিলা দেখতে যায় সবাই। বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলায় মূল শহর হতে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্র সমতল হতে তিন হাজার ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আলুটিলা বা আরবারী পাহাড়ে আলুটিলা গুহা অবস্থিত। স্থানীয়রা একে বলে মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা। এটি খাগড়াছড়ির একটি নামকরা পর্যটন কেন্দ্র। এই গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। রাত সাড়ে ১২টার দিকে সবাই কক্সবাজারে পৌঁছে যায়। হোটেলে ওঠে রাতের খাবার শেষ করে চলে যায় সুগন্ধা বিচে আর্জেন্টিনা এবং নেডারল্যান্ডসের খেলা দেখতে। তার পর রাত সাড়ে ৩টার দিকে এসে ঘুমিয়ে পড়ে অনেকে। পর দিন সকালে নাশতা শেষ করে সবাই মিলে চলে যায় সমুদ্রে গোসল করতে। বড় বড় ঢেউয়ে নিজেদের ভিজাতে ব্যস্ত সবাই। সঙ্গে ছিল ছবি তোলার ধুম। দুপর পর্যন্ত সুগন্ধা এবং লাবণী বিচে সবাই মিলে আনন্দঘন সময় পার করে। বিকেলে যাই সমুদ্রের পাশে হিমছড়ি পাহাড় দেখতে। তারপর পাটুয়ারটেক বিচে। রাতে সেখান থেকে ফিরে সবাই সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন মার্কেট থেকে কিনে মিয়ানমারের বিভিন্ন ধরনের আচার, শুঁটকি, চকলেট, শাল ইত্যাদি। তার পর সকালে ঘুম থেকে ওঠে রওনা হই সেন্টমার্টিনের দিকে।

জোয়ারের বিলম্ব হওয়ায় আমাদের সেন্টমার্টিন পৌঁছাতে দুপুর ২টা বাজে। আমরা ছিলাম সেন্টমার্টিন হেরিটেজ নামের একটি রিসোর্টে। যার অবস্থান ছিল বিচের একদম কাছে। রুমে থেকেই নীল পানি দেখা যায়। দুপুরে পাশের হোটেলে উড়ু মাছ দিয়ে লাঞ্চ শেষ করে সবাই। তারপরেই ছিল ভাটা, সবাই তখন ছবি তুলতে চলে যায় বিচের কাছাকাছি।

পরের দিন ভোর বেলা অনেকেই সূর্যোদয় দেখতে ওঠে খুব সকালে। এরপর সবাই মিলে নীল পানিতে গোসলে নামে। প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা গোসল করে সবাই। আমাদের বন্ধু উত্তম তো প্রায় সাত ঘণ্টা ওই নীল পানিতে লাফালাফি করে। তার মৃদু ঠান্ডা পানি এতটাই মন ছুঁয়েছিল যে সে আর সেখান থেকে বের হতে পারেনি। দুপুরে সুরমা মাছ খেয়ে আমরা যাই ছেঁড়াদ্বীপে। সেখানে ছিল অসংখ্য পাথর। যাকে আবার প্রবালদ্বীপও বলে। সেখানে নীল পানিতে সূর্য অস্ত দেখে ফিরে এলাম কটেজে। এরপর এখানে রাতে সবাই কেনাকাটা করে। রাতে হালকা ঝড়ো হাওয়াতে বসে আড্ডা, যা শেষ হয় মধ্যরাতে।

পর দিন সকালে মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পড়ে পাঞ্জাবি। শুরু হয় ছবি তোলার ধুম। এদিকে আমি আর উত্তম সকালে সমুদ্রের তীর বেয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাই দারুচিনি দ্বীপে। ছোট ছোট শামুক কুড়িয়ে চিপসের প্যাকেট ভর্তি করে উত্তম। আমি একটি সুন্দর কোরাল খুঁজে পাই। ভাবলাম কাউকে দেওয়া যাবে, তাই নিয়ে নেওয়া। ফিরে এসে সমুদ্রে গোসল শেষে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। বিকাল ৫টায় ছিল জাহাজ। তাই দুপুরে খেয়ে সবাই আগেভাগেই ঘাটে চলে যাই। কিন্তু ওখান থেকে ফিরতে মোটেই মন চাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল আরো থাকি। কিন্তু ফিরতে হবে। ১৪ ঘণ্টার মতো যাত্রা শেষে ফিরে এলাম ১ হাজার ২০০ একরের ক্যাম্পাসে। সাত দিনের এই ট্যুরে তৈরি হয়েছে অনেক মজার মজার স্মৃতি। ট্যুর শেষ, কিন্তু এই স্মৃতিগুলোই রয়ে যাবে আজীবন। বন্ধুত্বের এই আনন্দঘন দিনগুলোই বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিবে বারবার। পাহাড়, সমুদ্র আমাদের বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে থাকবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close