রেজাউল করিম শামিম

  ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

কুমিল্লা হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন : একটি স্বপ্ন একটি বাস্তবতা

জনঘনিষ্ঠ কাজ করার স্বপ্ন কজনাইবা দেখতে পারে? আর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নও কি এত সহজসাধ্য? কিন্তু, তেমনি এ অসাধ্যসাধনের কাজটি করে যাচ্ছেন একজন ডাক্তার। সংস্কৃতির পাদপীঠ আর ঐতিহ্যবাহী নগর, কুমিল্লায় থাকেন সেই ডাক্তার। তিনি হলেন তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ। তিনি শুধু স্বপ্নই দেখেন না। দক্ষ বুননে তার বাস্তব রূপ দেন। আর তার এই সৃষ্টিশীলতার জন্য তার জনপ্রিয়তা আজ শুধুই কুমিল্লা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ডাক্তার তৃপ্তীশ, একজন হৃদরোগ চিকিৎসক। সম্ভবত এ কারণে হৃদরোগ নিয়ে তার যত স্বপ্ন দেখা। তারই অংশ হিসেবে এই সময়ের সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করা মরণব্যাধি ‘হৃদরোগ’র ভয়াবহতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। সেই লব্ধ ধারণা থেকেই হৃদরোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়ে পরিকল্পনা নেন। শুরু করেন স্বপ্ন বুননের কাজ। তারই ফলে তার হাতে গড়ে উঠে ‘হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন কুমিল্লা।

অসাধ্যসাধনের স্বপ্নদষ্টা ডা. তৃপ্তীশের স্বপ্ন আজ বাস্তব। সেই ১০০৪ সালে, ১ সেপ্টেম্বর ছোট করে যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন, আজ তা হৃদরোধ-সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের জীবন বাঁচানোর পথ দেখিয়ে চলেছে। বিভিন্ন সময়, সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পজিয়াম, মিছিল, সাইকেল শোভাযাত্রা, পোস্টার, বিলবোর্ড স্থাপন, লিফলেট বিতরণ, পুস্তক প্রকাশ, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি- এসব তো আছেই। সেই সঙ্গে স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হৃদরোগের ভয়াবহতা এবং এ থেকে বেঁচে থাকার উপায় সম্পর্কে ধারণা দেওয়াসহ নানাভাবে, নানা পর্যায়ে লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে হৃদরোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার উপায়। বলা হয়েছে, নিজেকে বাঁচাতে, হার্টকে বাঁচাতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের কথা। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির স্লোগান ‘হৃদয় দিয়ে হার্টকে চিনুন’- খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জনকল্যাণমূলক অরাজনৈতিক এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু জনসচেতনতাই নয়। সেই সঙ্গে চিকিৎসা, পুনর্বাসন, গবেষণার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ডা. তৃপ্তীশের মতে, হৃদরোগটি মানুষের জন্য হৃদয়বিদারক। এখনই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তা মহামারি আকারে দেখা দেবে। তবে এর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা যেমনি আছে, তেমনি হার্টকে সুরক্ষিত রাখার প্রতিরোধ ব্যবস্থাও আছে। ফলে এ বিষয়ে প্রয়োজন জনসচেতনতা এবং নিত্যনতুন সমস্যা চিহ্নিত করা এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থার জন্য ব্যাপক গবেষণা।

ডা. তৃপ্তীশ আর তার প্রতিষ্ঠানের এমনি একনিষ্ঠ কর্মতৎপরতার কথা সহজেই পৌঁছে যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। যার কারণে ঢাকার বাইরের একটি সংগঠন ‘হার্ট কেয়ার ফাইন্ডেশন কুমিল্লা’ বিশ্ব হার্ট ফাউন্ডেশন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হয় স্বল্প সময়ের মধ্যেই।

আর সেই কর্মতৎপরতার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংগঠনের ললাটে যুক্ত হয় উজ্জ্বল একটি পালক। আর তা হলো ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন থেকে মোস্ট ইন্সপায়ারিং ওয়ার্ল্ড হার্ট ডে ক্যাম্পেইন ক্যাটাগরিতে ‘দ্য ওয়াল্ড হার্ট অ্যাওয়ার্ড’প্রাপ্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে এই প্রথমবারের মতো এমনি মর্যাদাপূর্ণ সম্মানসূচক পদকটি আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের জেনেভার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজিত আড়ম্ভরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে এই পদক তুলে দেওয়া হয়। হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশনের কুমিল্লার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ ও সহসভাপতি ডা. মল্লিকা বিশ্বাস এই পদক গ্রহণ করেন। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল পেনেইরো অনুষ্ঠানিকভাবে এই পদক তুলে দেন।

ডা. তৃপ্তীশ ও তার প্রতিষ্ঠানের এই সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পদকপ্রাপ্তি কাজের আরো প্রেরণা জোগাবে বলে তিনি এক একান্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তার একান্ত ইচ্ছে হচ্ছে হার্টের পরিপূর্ণ চিকিৎসার জন্য ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সবার সহযোগিতায় কুমিল্লাতে একটি আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা।

ডা. তৃপ্তীশ, নিজে একজন হৃদরোগ চিকিৎসক। রোগী আর চিকিৎসার প্রতি তার নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতা, সবশ্রেণি পেশার মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ফলে অনেকেই তাকে ‘হৃদয়ের ডাক্তার’ বলেও সম্মান করেন। অন্যদিকে হৃদরোগ মানেই ব্যয়বহুল চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে অনেককেই তিনি চিকিৎসা দেন বিনাপয়সায়। যার জন্য তার চেম্বারের সামনে ভিড় লেগেই থাকে। তাদের জন্য তিনি আবার গরিবের ডাক্তার। কিন্তু হৃদরোগের দ্রুত বর্ধিষ্ণুপ্রবণতা। অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাধিক্য, এই রোগের ব্যয় বহন করা সহজসাধ্য নয়। ফলে রোগের চিকিৎসা চেয়ে প্রারম্ভিক পর্যায় থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই হতে পারে সবচেয়ে বড় সহায়ক। এমনি ভাবনাই তাকে সার্বক্ষণিক ঘিরে থাকে বলে এক আলাপচারিতায় জানান ডা. তৃপ্তীশ। তার মধ্যে এমনি সেবামূলক কর্মের পরিকল্পনা এলো কী করে, এর উত্তর দিতে গিয়ে কথাগুলো বলেন। তিনি বলেন, হৃদরোগ চিকিৎসক হিসেবে তিনি ও তার সহধর্মিণীর মল্লিকা বিশ্বাস যথেষ্ট আয়-উপার্যন করেন। সংগত কারণেই তাদের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ হতে পারত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা বা সংশ্লিষ্ট ধারার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়া। কিন্তু পেশার বাইরে তারা দুজনে কবি এবং লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। দুজনেরই বেশ কিছু বই ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। এমনি সৃজনশীলতার মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাণিজ্যিক বিষয় তারা বরাবরই পরিহার করে চলেছেন। ফলে, সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই ঢাকার হার্ট ফাউন্ডেশনের আদলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা ভাবেন। আর সে ভাবনা থেকেই তারা প্রথমে ৭-৮ জন মিলে ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিলেন ‘হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন কুমিল্লা’ নিয়ে। তাদের মধ্যে উৎপল, ক্যারি রোজারিও, ন্যাপ নেতা জাকির হোসেন, শ্রমিক নেতা কমরেড আনোয়ার হোসেন, ভুতুবাবু, শাহজাহান চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

তিনি আরো বলেন, স্থানীয় এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার শুরু থেকেই তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে এসেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় সুধীজন থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাংবাদিক বিশেষ করে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের সার্বিক সহযোগিতায় আজকে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হতে পেরেছে।

সৃজনশীল স্বপ্ন দেখা আর ঐকান্তিক কর্মনিষ্ঠার স্বাক্ষর রাখা ডা. তৃপ্তীশের ইচ্ছে আছে সম্পূর্ণ অলাভজনক ও অবাণিজ্যিক এবং সত্যিকার অর্থেই একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যেখানে হৃদরোগ চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণা এবং পূর্বাসনের ব্যবস্থা থাকবে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তার এই স্বপ্নও এক দিন বাস্তব রূপ নেবে বলে সবার প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক সভাপতি কুমিল্লা প্রেস ক্লাব, জেলা সাংবাদিক সমিতি এবং সভাপতি জেলা ছাত্রলীগ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close