মাহমুদুল হক রিয়াদ

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মাছ ধরা থেকে ৬৪ জেলা ভ্রমণ

আসলেই রোজকার একই পরিবেশের মন যখন ক্লান্তি এবং একঘেয়েমিতে ভরে ওঠে, তখন নিত্যদিনের সেই চেনা চারপাশ থেকে আমাদের মন একটুখানি মুক্তির আনন্দের জন্য ছটফট করে। তখন মনকে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম দিতে এবং নিজের ক্লান্তি ও একঘেয়েমি দূর করতে প্রয়োজন হয় ভ্রমণের। রাফা নোমানের ৬৪ জেলা ভ্রমণ নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাহমুদুল হক রিয়াদ

নরসুন্দা নদীর তীরঘেঁষা ছায়ানিভিড় সবুজের সমারোহে একটি গ্রাম কুড়িমারা। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের উপার্জনের মাধ্যম কৃষি। বর্ষাকালে নদীতে নতুন পানির টইটম্বুর থাকাকালে সব মানুষ বনে যায় মৌসুমি মৎস্যজীবী। খাল, বিল, নালা, বাইত সব জায়গায় জোয়ান-বুড়া যে যেভাবে পারে সবাই সবাই মাছ ধরায় ব্যস্ত থাকে। মাছ ধরার এক উৎসব চলে কয়েক মাস। আবার গ্রীষ্মে হাঁটুজলে গোসল, শরতের কাশফুল, হেমন্তে গোলা ভরা ধান আর শীতের বাহারি পিঠা সব মিলিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর গ্রামটির অবস্থান কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায়। এই গ্রামের স্কুলে থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে ইচ্ছা জাগে সারা দেশ ঘুরে দেখার। পাঠ্যবইয়ে দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানের কথা পড়ার সময় নিজের কল্পনায় সে ভ্রমণ করে এখান থেকে সেখানে। বলছিলাম এই গ্রামের কাদা-মাটিতে বেড়ে ওঠা রাফা নোমানের কথা। দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

যেভাবে ভ্রমণ শুরু

রাফা নোমামের ভাষ্য মতে, স্কুলের পাঠ্যবইয়ে দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর ছবি দেখার পর থেকেই ভ্রমণ আমাকে টানতে শুরু করে। সেই থেকেই টুকটাক ঘোরাঘুরির চেষ্টা করেছি। স্কুলে থাকতে আমি আর চাচাতো ভাই দুজন মিলে পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম বিভিন্ন হাওর-বাঁওড়ে। সেখান থেকে মাছ ধরে সেই মাছ নিজেরাই রান্না করে খেতাম। কাদায় মেখে নিজেকে লুটিয়ে নিতাম আর ভাবতাম এক দিন এই দেশের সব হাওর-বাঁওড়, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত সুমদ্র ঘুরে দেখব। নিজেও কখনো ভাবিনি, এই স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরা থেকেই শুরু হবে আমার ৬৪ জেলা ভ্রমণ।

প্রথম অন্য জেলাতে ভ্রমণের শুরুটা ছিল একটু অন্যরকমভাবে, ২০১৩ সালের দিকে স্যার এসে ঘোষণা দিলেন কলেজ থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে। শিগগিরই নিয়ে যাওয়া হবে শেরপুরে। বন্ধু ও সহপাঠীরা মিলে দূরে কোথাও ঘুরতে যাব, এটা ভেবে অনেক আনন্দ হচ্ছিল।

কিন্তু, বাসায় এসে বলতেই আব্বা যেতে দিতে রাজি হলো না। ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল আমার। তবে স্যারদের পীড়াপীড়িতে আব্বা রাজি হলেন এবং নিজেকে অন্যভাবে খোঁজার এবং নতুন কিছু দেখার যাত্রা শুরু এখান থেকেই।

প্রজেক্ট হাতে নিয়ে ভ্রমণ

স্কুল ও কলেজ জীবন শেষে চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা তার। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের হাত ধরে সুযোগ হলো একটা প্রজেক্টে জয়েন করার। কাজ হলো উত্তরবঙ্গের গ্রামে-গ্রামে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে রিসার্চ সার্ভে করা। এই প্রজেক্টে রংপুরের বেশির ভাগ গ্রামে গিয়ে কাজ করা হয় অনেক দিন। বজ্রপাত আর ঝড় উপেক্ষা করেই হাওরে নৌকা নিয়ে ভেসেছি দিন-রাত। তখন ঘোরাঘুরির স্বপ্ন আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। প্রতিটি জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি জানার প্রবল ইচ্ছা জাগে।

রোডম্যাপ তৈরি করা

প্রথম দিকে যখন যেদিকে সুযোগ হয়েছে ঘুরলেও শেষে এসে বিভাগ ঠিক করে ঘুরত সে। আগে থেকে রুট প্ল্যান অনুযায়ী পাশাপাশি কয়েকটা জেলা ঠিক করে ঢাকা থেকে যাত্রাপথ শুরু করত। একেক জেলার কোান স্থানগুলো দেখবে, কোন জেলার পর কোন জেলা, আবার ঢাকা ফেরার সহজ রাস্তা কিংবা কম খরচে কীভাবে ঘোরা যায় রোডপ্ল্যানে সেগুলো থাকত। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট কিংবা পরিচিতদের সাহায্য নিত সে।

পরিবারের সাপোর্ট ও অর্থের জোগান

পড়াশোনার পাশাপাশি তার ঘোরাঘুরি বেশির ভাগ মানুষ বাঁকা চোখে দেখত। কিন্তু তার পরিবার সাপোর্ট দিয়েছে, বড় বোন রাত জেগে থাকত সকালে পৌঁছে মেসেজ দিলে তখন ঘোমাত। তার বাবা মারা যাওয়ার পর বেশ কিছু দিন ঘোরাঘুরি বন্ধ ছিল। তখন দুই বোনের উৎসাহে আবার শুরু করে। নিজের জব আর বাসা থেকে টাকা দিলে তা হাতখরচ কমিয়ে ঘুরত সে। করোনায় চাকরি ছেড়ে দিলে শেষের জেলাগুলো ভ্রমণে দুই বোন তাদের জমানো টাকা থেকে সাহায্য করে।

ভ্রমণের সুখকর স্মৃতি

সে জানায়, ৬৪ জেলা ঘুরতে গিয়ে মনে হয়েছে পুরো দেশটাই কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি। সব জেলা ঘুরতে গিয়ে বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছে, এক জীবন চলে যাবে গল্প করে তবুও শেষ হবে না। এক লোকের কথা আমার মনে শক্তভাবে গেঁথে আছে। গাইবান্ধায় একটা ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে এক চাচাকে জিজ্ঞাস করি, উনি ভালোভাবে বুঝিয়ে নৌকা ঠিক করে দেন বেশ দূরে হলেও উনি সহজেই চিনেন। উনাকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে বলেছিলাম, উনারা খুব ভালো মানুষ। উনি উত্তরে বলেন, ‘বাবা আমরা বোকাণ্ডসোকা, সহজ-সরল মানুষ গ্রামে রয়ে গেছি, চালাক আর প্যাছলাগানো মানুষ শহরে চলে গেছে। তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে তাকে চিনো না, আমাদের গ্রামে চিনতে হয়। একে অপরের সুখে-দুঃখে পাশে থাকি। শহরে মানুষগুলো পাথর হয়ে গেছে, তাদের প্রাণ নেই।’ ইটপাথরের শহরে থাকলে নিজেকে প্রাণহীন এই মনে হয়।

শেষ জেলা জয়

তার শেষ জেলা ছিল বরগুনা। সে বলে, পিরোজপুর থেকে বিষকালী নদী পার হয়ে বরগুনার বেতাগীতে ঢুকেছিলাম। প্রকৃতি হুট করে একটু বৈরী হয়ে গেল। ভাদ্র মাসে হুটহাট বৃষ্টি চলে আসে সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস। সমুদ্রের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকা আর বর্ষায় ফুলেফেঁপে থাকা নদীর রুদ্রমূর্তি শুরু হলো চোখের সামনে। বৃষ্টি আর ঝড়োহাওয়ায় নৌকা বেশ বিপাকে। নদীর তীরে লোকালয়ের কোনো দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছিল এত বড় পৃথিবীর, ছোট একটা দেশের, ছোট একটা নদীতে, আমি কত কিঞ্চিৎ জায়গা দখল করে আছি। এই নদী আমাকে গিলে খেলেও তার কিছুই হবে না। আমি এই নদীর কাছে সামান্য এক মানব মাত্র। নৌকা বাতাসের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। মাঝির কাছে তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাচ্ছি ধীরে-ধীরে। হঠাৎ দেখি অর্ধেকের বেশি পার হয়ে গেছি সামনেই ঘাট। তখন গলায় পানি ফিরে আসছে। অবশেষে উত্তাল নদী পার হয়ে বেতাগী পৌঁছালাম। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিল, তা লিখে বোঝানোর মতো কোনো যন্ত্র এখনো তৈরি হয়নি। আল্লাহ?র কাছে শুকরিয়া আদায় করতে করতে বেঁচে ফেরা আর ৬৪তম জেলায় পা দেওয়ার আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। ভ্রমণসঙ্গী প্রীথমদাকে জড়িয়ে ধরে চোখ লুকাইলাম। তখন চিৎকার করে বলেই উঠলাম। ‘আহ্ জীবন সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর, বেশ সুন্দর’- এত বছরের লালিত স্বপ্নপূরণ হওয়ার পর কিছু সময়ের জন্য মাথা ব্ল্যাক আউট হয়ে গিয়েছিল। পরিবারের সবার মুখের ছবিগুলো ভেসে উঠেছে বারবার।

ভ্রমণ নিয়ে চাওয়া ও পরিকল্পনা

তার মতে, দেশের বেশ কিছু রাজবাড়ি ও ঐতিহাসিক জায়গা আছে সেগুলা ট্যুরিস্টদের জন্য সেইফ না। রক্ষণাবেক্ষেণ ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। অনেক জায়গায় মদণ্ডজুয়ার আড্ডা হয়। আর সব থেকে বড় সমস্যা হলো যাতায়াত ভাড়া ও খাবার খরচ। যে যার মতো দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারের উচিত এই জায়গাগুলোতে নজর দেওয়া। ভ্রমণ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে সে বলে, প্রতিটি গ্রাম ঘোরার ইচ্ছে এখন তার। ৬৪ জেলায় চেষ্টা করেছি প্রতিটির ঐতিহাসিক আর দর্শনীয় জায়গায় যেতে। এবার ৬৫ হাজার গ্রাম ঘুরতে চাই। প্রতিটি গ্রামের ঐতিহ্য, ইতিহাস সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চাই। আল্লাহ চাইলে সব শেষে ভ্রমণ নিয়ে একটা বই বের করব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close