বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
সিরাজদিখানের ঐতিহ্যবাহী ‘পাতক্ষীর’
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান বাজারে গিয়ে জানা গেল এখানে পাতক্ষীর নামে এক বিশেষ মিষ্টি পাওয়া যায়, যা ভীষণ প্রসিদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী। সিরাজদিখানের স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এলাকায় পাতক্ষীর খুবই জনপ্রিয় এবং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এটি তাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পাতক্ষীর মুন্সীগঞ্জ তথা সিরাজদিখানের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। কলাপাতায় মোড়ানো এই মিষ্টি হচ্ছে সাধারণ ক্ষীরের একটি বিশেষ সংস্করণ। এই ক্ষীর তৈরি করার পর পাতায় মুড়িয়ে পরিবেশন করা হয় বলে এর নামকরণ করা হয় পাতাক্ষীর, যা বর্তমানে পাতক্ষীর নামে পরিচিত।
প্রথাগতভাবে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রামের সাতটি পরিবার এখনো পাতক্ষীর তৈরির কাজে জড়িত। লিপিবদ্ধ ইতিহাস না থাকলেও লোকমুখে জানা যায়, প্রায় দেড় শ বছর আগে এর সূচনা হয়েছিল পুলিন বিহারী দেবের হাত ধরে। তিনিই সর্বপ্রথম তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে পাতক্ষীর তৈরি করে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করতে থাকেন। তার দেখাদেখি ওই একই সময়ে ইন্দ্রমোহন ঘোষ এবং লক্ষ্মীরানী ঘোষও তৈরি করতে শুরু করেন পাতক্ষীর। এখন তাদের বংশধররাই বানাচ্ছেন এই ক্ষীর। তাদের উত্তরসূরি কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, ভারতী ঘোষ, সুনীলচন্দ্র ঘোষ, রমেশ ঘোষ, বিনয়ঘোষ, মধুসূদন ঘোষ, সমীর ঘোষ ও ধনা ঘোষ এই পেশায় রয়েছেন। কিন্তু এই পাতক্ষীর পারিবারিক ঐতিহ্য ও ব্যবসা হলেও মজার ঘটনা হলো, পরিবারের মেয়েদের এই মিষ্টি বানানোর রীতি শেখানো হয় না। এই পদ্ধতি রপ্ত করে তাদের পরিবারের পুত্রবধূরা। কারণ হিসেবে জানা যায়, মেয়েরা বিয়ের পর অন্যত্র চলে যায়; যাতে তাদের এই মিষ্টির পদ্ধতি বিয়ের পর হস্তান্তর না হয় তাই এ ব্যবস্থা।
পাতক্ষীরের কারিগরদের মতে, এই মিষ্টি বানানোর বিশেষ পদ্ধতি আছে। একটি পাতক্ষীর বানাতে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন লিটার দুধের প্রয়োজন হয়। কড়াইয়ে দুধ ঢেলে গনগনে আঁচে অনেকক্ষণ জ্বাল দিতে হয়। জ্বাল দেওয়ার সময় কাঠের তৈরি চামচ দিয়ে নাড়তে হয়, যাতে কড়াইয়ের তলায় দুধ লেগে না যায়। এরপর দুধ ঘন হয়ে এলে সামান্য পরিমাণে হলুদ ও চিনি মিশিয়ে চুলা থেকে নামানো হয়। চুলা থেকে নামানোর পর মাটির পাতিলে রেখে ঠাণ্ডা করা হয়। প্রায় এক ঘণ্টা পর ঠাণ্ডা হলে তা কলা পাতায় মুড়িয়ে বিক্রয়যোগ্য করা হয়। তবে হাতের যশ ও সঠিক কৌশল না জানা থাকলে ভালো পাতক্ষীর তৈরি করা যায় না। সিরাজদিখান উপজেলায় সদরের অনেক মিষ্টির দোকানেও পাতক্ষীর তৈরি হয়। এমন কয়েকটি দোকানের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের কারিগররা দোকানেই পাতক্ষীর বানিয়ে থাকেন। তাই সিরাজদিখান বাজারের রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মা ক্ষীর ভাণ্ডার ছাড়াও প্রায় সব মিষ্টির দোকানেই পাতক্ষীর পাওয়া যায়। এখানে প্রতিটি পাতক্ষীরের ওজন প্রায় আধা কেজি। দোকানভেদে দাম ২৫০-৩০০ টাকা। বিশেষ উৎসব ছাড়া সারা বছর এর চাহিদা থাকে। দোকানে বিক্রি ছাড়াও বাড়িতে এসে অর্ডার দিয়ে থাকে অনেক ক্রেতা। মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নানা উৎসব-আয়োজনে পাতক্ষীরের পরিবেশনা থাকবেই। এটি না হলে যেন আয়োজন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই এই এলাকার মেহমানদারি বা বড় বড় আয়োজনে পাতক্ষীর থাকা চাই। বাঙালি ঐতিহ্যের পাটিসাপটা পিঠা তৈরিতেও প্রয়োজন হয় পাতক্ষীরের। এমনকি এই এলাকায় নতুন জামাইয়ের সামনে পিঠাপুলির সঙ্গে পাতক্ষীর ব্যবহার না করা বেমানান হিসেবে ধরা হয়। এই অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে চিড়া-মুড়ির সঙ্গেও পাতক্ষীর খাওয়ার পুরোনো রীতি প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই মেহমান আপ্যায়নে সেমাই, পায়েসের সঙ্গে পাতক্ষীর পরিবেশন করে। সব মৌসুমে চাহিদা থাকলেও শীতকালে পাতক্ষীরের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। তাই মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের ঐতিহ্যবাহী পাতক্ষীরের স্বাদ যারা একবার নিয়েছেন, সেই স্বাদ আবারও নিতে তাদের এখানে ফিরতেই হবে।
"