বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
দূর পাহাড়ের শিশুরা
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার গুইমারা উপজেলার পাহাড়ি পথ ধরে এগোলেই পড়বে সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের বাজার। এখান থেকে ঘন সবুজ পাহাড়, নির্জন ও দুর্গম পাহাড়ি পথ, আঁকাবাঁকা স্বচ্ছ জলের ঝিরিপথ, বড় বড় পাথর, দুইশত বছর বয়সি প্রাচীন বটগাছ পেরোলেই চোখের সামনে ধরা দেবে প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা চমৎকার এক গ্রাম ‘আকবাড়ি পাড়া’। পাহাড়ি এই ছোট্ট গ্রামের সহজ সরল ও মিশুক স্বভাবের মানুষগুলো সবাই মারমা গোত্রের। ছোট ছোট প্রাকৃতিক বাড়িগুলো পেরিয়ে গ্রামের ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে গাছপালা দিয়ে ছাওয়া ভীষণ সুন্দর একটা ক্যাং বা বৌদ্ধমন্দির। এই উপাসনালয় এবং এর সম্মানিত বৌদ্ধভিক্ষু বা ভান্তে গ্রামের মানুষগুলোর কাছে ভীষণ ভক্তি ও শ্রদ্ধাবোধের জায়গায় থাকে। ক্যাংয়ে বসবাস করা সম্মানিত বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ভান্তের মতো গ্রামের সবাই খুবই সাদাসিধে কিন্তু প্রাকৃতিক জীবনযাপনে প্রচণ্ডরকম অভ্যস্ত। এর ছাপ পাওয়া যায় তাদের ঘরবাড়ি, পোশাক, চলাফেরা এবং খাওয়া-দাওয়াতেও।
আকবাড়ি পাড়ার ছোট বাড়িগুলোর অধিকাংশই প্রাকৃতিক উপাদান যেমন বাঁশ, বেত, ছন, বিভিন্ন গাছের কাঠ ও পাতা দিয়ে তৈরি। মাটি থেকে কাঠ বা বাঁশের খুঁটি দিয়ে খানিকটা উঁচুতে বাড়িগুলো তৈরি করা হয়। পাহাড়ের মানুষ বিশ্বাস করে এভাবে বাড়ি তৈরি করলে মাটি কম কষ্ট পায় এবং প্রকৃতির কম ক্ষতি হয়। অনেক বাড়ির সামনে চিকন বাঁশ দিয়ে উঠোনের মতো বেশ খানিকটা জায়গা তৈরি করা হয়। এতে অনেক সময় কাপড় ও খাদ্রসামগ্রী শুকানো হয়, বয়স্করা শীতের দিনে রোদ পোহায় এবং বাচ্চারা খেলাধুলা করে। যাইহোক প্রাকৃতিক এই বাড়িগুলো যেন গুচ্ছ গুচ্ছ শান্তির নীড়। ভেতরে বসে থাকলে দারুণ ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি পাওয়া যায়। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না সেরে পাহাড়ের কোলে কৃষিকাজ করে ও মাছ ধরেই সহজ-সরল জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পছন্দ করে এই গ্রামের সবাই। দিনের একটা অংশে গ্রামের তরুণ থেকে বয়স্ক সবাই দল বেঁধে জীবন-জীবিকা, নানা স্বপ্ন ও বাস্তবতার গল্প করতে ভালোবাসে। ছোট বাচ্চারা পাহাড়ের কোলে ছুটোছুটি করে খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকে। পাহাড়ের নিয়ম অনুযায়ী সবাই বেশ আগেভাগেই রাতের খাবার খেয়ে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে যায়। এভাবেই দিনের পর দিন এই গ্রামের সবার সময় কেটে যায়।
এই দুর্গম প্রাকৃতিক গ্রামে মানুষের মাঝে সুখ-শান্তি সবই আছে কিন্তু নেই শিশুদের ভালোভাবে গড়ে ওঠার জন্য সাধারণ চাহিদার বিষয়গুলো। বাচ্চাদের অধিকাংশই অপুষ্টিসহ নানা ধরনের রোগে প্রতিনিয়ত ভুগে থাকে। এরা ঠিকভাবে ভিটামিন, প্রয়োজনীয় ওষুধ, ভ্যাকসিন বা টিকাও সেভাবে পায় না। ফলে অনেক শিশুই নিয়মিত ডায়রিয়া, কলেরা, টায়ফয়েড, হাম, বসন্ত, প্রদাহ, জীবাণুঘটিত ফ্লু, ত্বকের রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। চিকিৎসা পেতে চাইলে এসব কোমলমতি শিশুকে দুর্গম এবং বিপৎসংকুল পাহড়ি ও ঝিরিপথ পেরিয়ে বহু দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়। তাই পাহাড়ের শিশুদের স্বাস্থ্য সব সময় ঝুঁকির মধ্য দিয়েই যায়। পাহাড়ে বসবাস করা এই পাড়ার শিশুরা সার্বিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আধুনিকতার ছোঁয়া তো দূরে থাক মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত এখানকার শিশুরা। অতিরিক্ত পুষ্টিহীনতায় ভোগে শিশুরা।
আকবারিপাড়া গ্রামে শিশুরা পাহাড়ি ছড়ার পানি পান করে। একটি নলকূপ থাকলেও তা পুরো গ্রামের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই এখানের শিশুরা বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগে থাকে। এ ছাড়া তাদের জন্য নেই কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা। তাই সঠিক খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত এখানকার শিশুরা। এখানের বাসিন্দাসহ শিশুদের কাছে নেই জনসচেনতার জন্য কোনো সাধারণ জ্ঞান। এখানে রোগব্যাধি হলে ঝাড়ফুঁক করা হয়। তাদের বিশ্বাস ঝাড়ফুঁক দিয়ে রোগ ভালো হয়ে যায়। বেশি অসুখ হলে দূরের হাসপাতালে নেওয়া হয়। এখানে রাস্তাঘাটও ঠিকমতো নেই। গ্রাম থেকে অনেক দূরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়, ফলে অনেক শিশুর সাধারণ রোগে অকালমৃত্যুও ঘটে।
যদিও কয়েক বছর আগেও ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়ার জন্য কোনো স্কুল। ফলে কেউ পড়ালেখা করতে চাইলে তাকে প্রতিদিন বহু দূরের স্কুলে যেতে হতো, যা ছোট বাচ্চাদের জন্য প্রচণ্ড কষ্টের ও ঝুঁকিপূর্ণ। ছোট ছোট কোমলমতি বাচ্চাদের এই অসহনীয় কষ্ট দেখে স্থানীয় কিছু উদ্যমী ও স্বপ্নবাজ তরুণের চিন্তার জগতে প্রচণ্ডভাবে আলোড়ন তোলে। তারা অল্প অল্প করে স্বপ্ন বুনতে থাকে আকবাড়িপাড়ায় একটি স্কুলের জন্য। আর এর জন্য অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয় তাদের। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাহস ও সাহায্যগুলো জমিয়ে প্রতিনিয়ত সেই দুর্গম গ্রামে স্কুলের জন্য যাওয়া এবং কয়েক দিন থেকে স্থানীয়দের নিয়ে কিছু কিছু কাজ করে আসা চলতে থাকে। এর মাঝে কত রোদণ্ডবৃষ্টি-ঝড় মাথার ওপর দিয়ে যায়, তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এই তরুণদের! একসময় তাদের একাগ্রতা, শক্তিশালী মানসিকতা, কঠোর পরিশ্রম এবং বিভিন্ন সহানুভূতিশীল মানুষের সহায়তায় গুটিগুটি পায়ে দাঁড়িয়ে যায় স্বপ্নের ‘আকবাড়িপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
পাহাড়ের কোলে স্থাপিত এই স্কুলের শরীর জুড়েই দেখা যায় চিরসবুজ বাংলাদেশ ও এর পাহাড়ের প্রাকৃতিক রং। সবুজ রঙের স্কুলটি দেখলেই চোখ জুড়িয়ে আসে। একসময় আস্তে আস্তে স্কুলের বাচ্চাদের পোশাক, বই-খাতা, টেবিল-চেয়ারও জোগাড় হয়। এমনকি সোলার প্যানেল দিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। সুন্দর এই স্কুলের জানালা দিয়ে ছোট্ট মিষ্টি বাচ্চাদের চোখে ধরা দেয় নতুন দিনের স্বপ্নের ঝিলিক। তবে শিশুদের এই স্বপ্ন দেখা প্রতিনিয়তই বাধাগ্রস্ত হয়। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলের ব্যবস্থাপনা প্রায়ই থমকে যায় নিয়মিত সাহায্যের অভাবে। খাদ্য সংস্থানের জন্য বাচ্চারা খুব অল্প বয়স থেকে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে জুমচাষসহ নানা কঠিন পরিশ্রমের কাজে যায়। ফলে তাদের স্কুলে ধরে রাখাই অনেক সময় কঠিন হয়ে আসে। এর মাঝে স্কুলে যখন সাহায্যের অভাব দেখা দেয়, তখন পুরো ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে, ফলে স্কুলের কার্যক্রম স্তিমিত বা প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। শিক্ষাদানও ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই পাহাড়ি গ্রামের শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সঠিক আন্তরিকতা, পরিকল্পনা, সমন্বিত উদ্যোগ এবং ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে পারলে ছবির মতো পাহাড়ি ‘আকবারিপাড়া’ গ্রামের মায়াবী মুখের শিশুরা ছোট ছোট রঙিন প্রজাপতির মতো আনন্দে উড়ে বেড়াতে পারবে। তা দেখে নিশ্চয়ই তৃপ্তি, আনন্দ, গর্ব ও নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে চোখের কোণে জল মুছবে আকবাড়িপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ
মারমারা।
লেখক : সমাজকর্মী ও ফার্মাসিস্ট
"