আর এম রিফাত

  ২৫ মার্চ, ২০২৪

বনসাইপ্রেমী রায়হানের গল্প

বিশ্বের এক ভয়ানক নাম করোনা। যার ভয়াল গ্রাসে জনজীবন থমকে গিয়েছিল। ওই সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রে অবস্থা ছিল শোচনীয়, যা ছিল সবার জন্য দুঃখজনক। তবে কারো কারো জন্য এই করোনাকালীন সময় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। ব্যতিক্রম ঘটেনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এনামুল রায়হানের জীবনেও। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাসা যশোরের মনিরামপুরের ঝাঁটা গ্রামে। করোনাকালীন সময়ে যখন অবসর সময়গুলো কাটছিল না, ওই সময়টাতে তার মনে প্রবল হতাশা ও বিষণ্ণতা ভর করেছিল। সেই নিকষ সময়গুলো কাটত স্মার্টফোনে, ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে এক দিন দেখলেন বনসাইয়ের কথা। এটা দেখার পর অনলাইন ঘাঁটাঘাঁটি করে বনসাই সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। নেমে পড়লেন বনসাইয়ের খোঁজে। বনসাই করার বাসনা থেকেই অনলাইন মাধ্যম ও খুলনা বিভাগের ৩৫টি নার্সারি ঘুরে একে একে সংগ্রহ করতে লাগলেন বনসাই। ছোট থেকেই তিনি বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন, প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিতে নিজ বাসার ছাদে ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন নার্সারি। এরপর থেকেই রায়হানের অবসর সময় কাটে ছাদবাগানে। একে একে ছাদবাগানে বিশের অধিক বনসাই যুক্ত করলেন। বনসাইয়ের পাশাপাশি সেখানে ফলদ ও সবজি দিয়ে বাগান পূর্ণ করেন।

এদিকে ছাদবাগানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতেই না হতেই, সময় ঘনিয়ে এলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়, মায়ার বন্ধন বনসাই ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতে হয়। প্রথম প্রথম ছাদবাগান ছেড়ে থাকতে তার কষ্ট হতো। পরে ভাবলেন ইবিতেও বনসাই বাগান করার। তিনি যে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলে, সেখানে দুই দুটি ব্লক রয়েছে। দোতলায় এক ব্লক থেকে আরেক ব্লকে আসা-যাওয়ার রাস্তা রয়েছে। সেই জায়গাটি কাজে লাগালেন তিনি। চলাচলের দুপাশে বনসাই সংগ্রহ করে এনে পরিচর্যা শুরু করলেন। সময়ের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও গড়ে তুললেন একটি বনসাই বাগান। দুই ব্লকের দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থতলার করিডর থেকে তাকালেই রায়হানের বাগানের দেখা মেলে। এই বনসাই বাগানটি জিয়া হলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। প্রায় সময়ই সেখানে বসে হলের শিক্ষার্থীরা আড্ডার আসর জমান। তার এমন উদ্যোগের প্রশংসা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী হানিফ হোসেন বলেন, ‘প্রকৃতির প্রতি তার রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। এমন আগ্রহ দেখে আমার নিজেরও ইচ্ছে হয় বাগান করার।’

রায়হানের বাড়ির আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদবাগান মিলে ৪৫-এর অধিক বনসাই, ৩০-এর অধিক ফলদ ও ৫-এর অধিক সবজিসহ রয়েছে ইনডোর প্ল্যান। ছাদবাগানের পাশাপাশি ইনডোরও সাজিয়েছেন বনসাই দিয়ে। ভেতরে তাকালে দেখা মেলে বিভিন্ন রকম ফুলের গাছসহ নানা ধরনের বৃক্ষ, যা সবাইকে মুগ্ধ করে।

তিনি জানান, তার ছাদবাগানে দেশি বট, চায়না বট, তেঁতুল, কতবেল, পেয়ারা, বাগান বিলাস, ঝুমুর, চন্দন, গোলাপ, কাটামোকট, বতল বিলাস, লক্ষ পাকুড়, পাকুড়, জবা, বারবাডোস চেরি, টগর, অর্জুন বলকামিনীসহ নানা জাতের বনসাই রয়েছে। তার বাড়ির ছাদে রয়েছে আপেল, আতা, আঙুর, জামরুল, সফেদা, পেয়ারা, অস্ট্রেলিয়ান লেবু, স্ট্রবেরি, স্ট্রবেরি পেয়ারা, থাই পেয়ারা, আমলকী, মালবেরি ব্ল্যাকবেরি, আপেল কুল, জলপাই, আমড়া, মালটা, কাগুজে লেবু, কাটিমন আম, রামবুটান, কতবেলসহ নানা প্রজাতির ফলজ উদ্ভিদ। যেখানে আপেল ছাড়া সকল গাছে ধরেছে ফল। এ ছাড়া রয়েছে শসা, লাউ, শিম, মিষ্ট কুমড়াসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজি।

রায়হান বলেন, ‘একজন শিশুকে মানুষ করতে যে ধরনের পরিশ্রম এবং সময় দেওয়া হয়। ঠিক তেমনি বনসাই ও ফলদ বাগানে আমাকেও সেভাবে সময় দিতে হয়। এক সঙ্গে নিজেই দুটি বাগান দেখাশোনা করি। বাড়ির ছাদবাগান দেখার জন্য প্রায়ই আমাকে গ্রামে যেতে হয়। এতে আমার কোনো ধরনের কষ্ট হয় না। বাগান করার ভেতরে মনের মাঝে যে আনন্দ কাজ করে, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এটি আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে।’

বৃক্ষগুলো টিকিয়ে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘বনসাই টিকিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। বাগান টিকিয়ে রাখতে জৈব সার, নিচ কুটি, হাঁড়ের গুঁড়ো, ডিমের খোসা, খৈল পচাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়।’

বনসাইয়ে তার স্বপ্নের কথাও তিনি জানিয়েছেন, ‘ভবিষ্যতে জেলার বৃক্ষমেলায় একক প্রদর্শনী হিসেবে ২০০ গাছ রাখার ইচ্ছা রয়েছে।’

এ ছাড়া তিনি বলেন, ‘আমার থেকে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে বনসাইয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মেছে। তারা আমার কাছে এলে পরামর্শ দিই কীভাবে বৃক্ষগুলোর ডাল থেকে বনসাই করা সম্ভব। তা আমি তাদের ফ্রিতে দেওয়ার পাশাপাশি পদ্ধতি শিখিয়ে দিই। এভাবেই মানুষ ও প্রকৃতির ভালোবাসা নিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চাই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close