বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

  ১৮ মার্চ, ২০২৪

সেই গুড়ের শরবত!

মনে পড়ে নানু-দাদুর মায়াময় হাতে তৈরি সেই গুড়ের শরবতের কথা? গরমে একটু তেষ্টা পেতেই আবদার, আর তাতেই হাজির গুড়ের শরবত! কাসার গ্লাসে গভীর নলকূপ বা কুয়ার পানি নিয়ে তাতে যোগ করা হতো আখের তাজা গুড়। বাড়ির রান্নাঘরের পেছনের কাগজি লেবুগাছ থেকে সতেজ পাতা নিয়ে এসে চটকে দেওয়া হতো তাতে। সবকিছু মিশ্রিত করে পান করতেই নিমিষেই তেষ্টা উধাও। আহ! কি স্বাদ আর সুঘ্রাণ মিশে ছিল সেই জাদুকরী গুড়ের শরবতে। স্মৃতিতে অম্লান সেই জাদুকরী গুড়ের শরবতের এক কারিগরের খোঁজ মিলল কাইকারটেকের হাটে এসে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে গড়ে উঠেছে কাইকারটেকের হাট, যা প্রাচীন ঐতিহ্য গৌরবের সঙ্গে বুকে লালন করে চলেছে। হাটের প্রাচীন নিদর্শন ও পাতা ঝরা কড়ই এবং হিজলগাছগুলোও যেন হাটের বয়সকালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এমনই এক প্রাচীন ও প্রাকৃতিক হাটের ভিড়ের ভেতরে হাঁটতে গিয়ে চোখ চলে গেল একজন বৃদ্ধকে ঘিরে গড়ে ওঠা জটলার দিকে। কাছে গিয়েই টের পেলাম সবাই লেবু-গুড়ের শরবত পান করার জন্য বৃদ্ধের দোকান ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমিও এক গ্লাস শরবতের চাহিদা জানিয়ে দিলাম। শরবত তৈরি হওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বৃদ্ধের সঙ্গে গল্প জমে উঠল। কথায় কথায় জানতে পেলাম বৃদ্ধের নাম নজীবর রহমান। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ বন্দরের নবীগঞ্জে। দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে হাটে হাটে গুড়ের শরবত বানিয়ে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। দুই ছেলে এক মেয়েকে স্বাবলম্বী করেও কাজ থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। প্রশ্ন করলাম ছেলেমেয়ে আপনাকে দেখে না। খানিকটা চুপ থেকে বললেন, তিনি ছেলেমেয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকতে ইচ্ছুক নন; তাই তো এই বয়সেও হাটবারের দিন সব প্রস্তুতি নিয়ে ছুটে যান কখনো নাঙলবন্ধ, কখনো সোনাগঞ্জ আবার কখনো কাইকারটেকের হাটে।

এর মাঝে আমার হাতে চলে এসেছে বৃদ্ধ নজীবর চাচার গুড়ের শরবত। কয়েকটা চুমুক দিতেই প্রাণজুড়ে প্রশান্তি নেমে এলো, এই শরবত যেন ফিরিয়ে নিয়ে গেল ফেলে আসা শৈশবে। মনে পড়ে গেল নানু-দাদুর মায়াময় হাতে তৈরি সেই গুড়ের শরবতের কথা। নজীবর চাচার জাদুকরী হাতে বানানো গুড়ের শরবত নিয়ে জানতে চাইলাম। চাচা জানালেন তিনি নিজেই খুঁজে খুঁজে ভালোমানের আখের গুড় ও বাগান থেকে সুগন্ধি লেবু বিশেষ করে কাগজি ও এলাচি লেবু সংগ্রহ করেন। সব সময় চেষ্টা করেন তাজা গুড় ও লেবু ব্যবহার করতে। এমনকি বরফও ভালো পানি দিয়ে তৈরি করেন। আর তাই তো দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে হাটে হাটে শরবতপ্রেমীদের পিপাসা মিটিয়ে আসছেন।

তিনি কারো বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা করতে ইচ্ছুক নন। আর তাই তো তার হাতে বানানো গুড়ের শরবত পান করতে অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে চলে আসে। তিনিও আগ্রহের বসে ক্লান্তিহীনভাবে ঘষে ঘষে বরফকুঁচি তৈরি করে টিনের গ্লাসে নিয়ে তাতে তাজা গুড় নিয়ে ঘুঁটনি দিয়ে হাতের সাহায্যে নেড়েচেড়ে শরবত বানান। শেষে গ্লাসে ঝাঁকিয়ে নিয়ে মিশিয়ে দেন সতেজ, তাজা ও সুগন্ধি লেবুর টুকরো। পরিবেশনের সময় কাচের গ্লাসে বরফ গুড়ের মিশ্রণের মাঝে ভাসতে থাকা লেবুর টুকরোয় লেগে থাকা পানির বিন্দু যেন নজীবর চাচার শরবতের প্রতি তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়। প্রতি গ্লাস শরবত তিনি দশ টাকা করে বিক্রি করেন। শীতের সময় বিক্রি কমে এলেও গরমের সময় দিনে প্রায় ২৫০-৩০০ গ্লাস গুড়ের শরবত বিক্রি করেন।

কাইকারটেক হাটে গিয়ে নজীবর চাচার গুড়ের শরবতের স্বাদ নিতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে সোনারগাঁয়ের কাছে মোগরাপাড়া চৌরাস্তায়। সেখান থেকে ডানের কিছুটা পথ এগোলেই পেয়ে যাবেন কাইকারটেক হাট। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বোরাক এসি বাস সার্ভিস ও নন-এসি স্বদেশ কিংবা দোয়েল পরিবহনের বাসে সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামলে কাইকারটেক হাট যাওয়ার সিএনজি পাবেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরের চাষাঢ়া থেকে নবীগঞ্জ ঘাট পার হয়েও কাইকারটেক হাট যাওয়া যায়। আর মুন্সীগঞ্জ থেকে নৌরুটে ট্রলার বা বোট ভাড়া করে সরাসরি পৌঁছাতে পারবেন ঐতিহ্যবাহী এই হাটে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close