বোরহান উদ্দিন

  ০৪ মার্চ, ২০২৪

শাকিলের স্বেচ্ছাসেবী হয়ে ওঠার গল্প

রক্তের জন্য কান্না করছিল মধ্যবয়স্ক এক নারী। আশপাশে অনেক মানুষ থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি কান্নারত অবস্থায় বলছিলেন তাকে ডাক্তার বলেছেন ইমারজেন্সি রক্ত দিতে না পারলে তার মুমূর্ষু মাকে (ক্যানসার আক্রান্ত) বাঁচানো সম্ভব হবে না। বিষয়টি গভীরভাবে দাগ কাটে পাশেই থাকা এক যুবকের। দিনটিতে ছিল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে তিনি ছুটে যান হাসপাতালে। রক্ত দেওয়ার পর হাসপাতাল থেকে তড়িঘড়ি করে রওনা হন পরীক্ষা কেন্দ্রে। কিন্তু সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে না পারায় পরীক্ষা দেওয়া তার সম্ভব হয়নি- বলছিলাম সাতক্ষীরার দরগাহপুর গ্রামের আবদুল কাদেরের ছেলে শাকিলের কথা।

গল্পটি ছিল ২০১৭ সালের, জীবনের ১মবারের মতো রক্তদানের অনুভূতি অর্জন করেন শাকিল। এরপর থেকে শুরু হয় মানবিক কাজ নিয়ে তার পথচলা। মানবিক কাজের জন্য সংগ্রাম মোটেও সহজ ছিল না। রক্তদানের পর দীর্ঘদিন অসুস্থতার বোঝা শরীরকে টানতে হয়। তবু তিনি দমে যাননি।

এরপর ২০১৮ সালে শাকিল সাতক্ষীরা থেকে চলে আসেন ঢাকায়, ভর্তি হন রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত সরকারি বাঙলা কলেজে। ক্যাম্পাসের আশপাশে অবস্থিত প্রায় ডজনখানেক হাসপাতাল থেকে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা রক্তদাতা খোঁজার জন্য বাঙলা কলেজের ক্যাম্পাসে আসতেন। এসব ঘটনা শাকিলের নজরে প্রতিনিয়ত পড়তে থাকল। কী করা যায়? তখন শাকিলের স্মার্টফোন ছিল না। শাকিল চিন্তাভাবনা করলেন রক্তের জন্য রোগীর স্বজনরা ক্যাম্পাসে এলে নিঃস্বার্থভাবে ?রক্ত মেনেজ করে দিয়ে পাশে দাঁড়াবেন। কম দামি একটা স্মার্টফোন কিনে নিজ উদ্যোগে অনলাইনের মাধ্যমে ব্লাডের সংগঠন তৈরি করলেন। নামকরণ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের নাম অনুসারে ‘৭ কলেজ ব্লাড অর্গানাইজেশন’। যেখানে নিঃস্বার্থভাবে শ্রম দিচ্ছেন ৭ কলেজের স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীরা। এরপর রক্তের প্রয়োজনে পেছনে তাকাতে হয়নি শাকিলের। ক্যাম্পাসে প্রতিদিন রোগীর স্বজনরা আসতেন, তাদের বিনামূল্যে রক্তের ব্যবস্থা করে দিতেন শাকিল ও তাদের টিম। কিন্তু মানবিক কাজ করার জন্য অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে শাকিলের।

‘৭ কলেজ ব্লাড অর্গানাইজেশন’ ৬ বছর ধরে মানবসেবায় নিয়োজিত রয়েছে। রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, রক্তদানের আহ্বান, সচেতনতার বার্তা, মুমূর্ষু রোগীকে রক্তদাতা ম্যানেজসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। গরিব, অসহায় ও অভুক্তদের জন্য ‘রুটি দিবস’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী অঙ্গনে শাকিল এখন অনেকটাই পরিচিত একটা মুখ। নিজের মেধা, শ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে দেশের ৬৪ জেলার ভলান্টিয়ারদের মধ্যে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে পেরেছেন। কোভিড-১৯-এর সময় নিজ এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা করেছেন। এ ছাড়া কয়েকজন যুবককে নিয়ে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা ও অসহায়দের খাবার বিতরণের মতো মহান কাজেও শাকিল ছিলেন সক্রিয়।

বেকারত্বের মাঝেও নিজের কথা চিন্তা না করে প্রতিনিয়ত পথশিশুদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান করাচ্ছেন। বর্তমানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তিনটা স্কুলে শিক্ষক হিসেবে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিভিন্ন জেলায় ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম ও ফেসবুক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মানুষকে রক্তদানসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান করছেন। বর্তমানে সব ধরনের মানবিক কাজের সঙ্গে জড়িত শাকিল। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার মধ্যে কুড়িগ্রাম বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কোরবানির ঈদও পরিবার ছাড়া অপরিচিত কুড়িগ্রামে করেছেন। ফলে পড়াশোনায় কম সময় দেওয়ায় পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। এটা নিয়েও বিন্দুমাত্র আফসোস নেই শাকিলের।

কারণ জানতে চাইলে শাকিল বলেন, ভালো কাজের পেছনে সময় দিতে পাচ্ছি এটা নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালার এক ধরনের নিয়ামত। সুতরাং আমি সেই নিয়ামত থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাই না। এ ছাড়া শাকিল তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা যারা ভালো কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন, তারা কখনো ভুলেও এটার প্রতিদান আশা করবেন না। মনে রাখা উচিত এগুলো আল্লাহতায়ালার এক ধরনের নিয়ামত। আমরা সৌভাগ্যবান যে ভালো কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রাখতে পেরেছি। এ জন্য সব সময় শুকরিয়া করা উচিত।’

শাকিল তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি আমার বাবাকে দেখেছি মানুষের বিপদে এগিয়ে যেতে। সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে। বাবার এমন মানবিক কাজ দেখে প্রতিনিয়ত হৃদয়ে কড়া নাড়ত। সংসারে অভাব-অনটনের ভেতরও বাবা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ান। তখন থেকে স্বপ্ন দেখতাম কখনো সুযোগ পেলে আমিও বাবার মতো ভালো কিছু করব, মানুষের বিপদে পাশে থাকব, তাদের সাহায্য করব। তাই বাবার মতো আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। বাবার মানবিক কাজ থেকে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার বাবা এখনো মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন, এটা আমাকে প্রতি মুহূর্তে আনন্দ দেয়।’

নিজ গ্রামে শাকিলকে এসব মহান কাজের জন্য সবাই ভালোবাসে ও সর্বদা পাশে থাকে। এ ছাড়া হাসপাতালে রোগীকে সেবা করতে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটানো হয় শাকিলকে প্রতিনিয়ত। ব্যস্ততার মধ্যেও রক্তদান করতে ভুলেন না। ২২তম রক্তদান সম্পন্ন হয়েছে গত ভাষার মাসে। মৃত্যুর পর নিজের চোখ দুটোকে দান করার অঙ্গীকারে বদ্ধ শাকিল। সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে মরণোত্তর চক্ষুদাতা হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছেন। কনকনে শীতের ভেতরও নিজেকে বিলিয়ে দিয়েনেছ মানবসেবায়। শীতবস্ত্র, গরম পোশাকের মাধ্যনে ভালোবাসা কুড়িয়েছেন উত্তরবঙ্গের অসহায় শীতার্ত মানুষদের কাছে থেকে।

শাকিল একজন স্বেচ্ছাসেবী, একজন রক্তদাতা, একজন মরণোত্তর চক্ষুদাতা, পথশিশুদের সেবক, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষক, কোভিড-১৯ যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত।

শাকিল বলেন, পথশিশু/সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো তাদের মাঝে পৌঁছে দিয়ে মানবসম্পদে পরিণত করতে চাই। শাকিল ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে পাঠদান করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শাকিল স্যার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close