রাকিব রিফাত

  ১১ মার্চ, ২০২৪

হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ইবি সিওয়াইবির ২৬ তারিখ

দিনটি ২৬ ফেব্রুয়ারি, ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৮.২৪। এমন সময় সিওয়াইবি ইবি শাখার সভাপতি গোলাম রব্বানীর ফোন। ঘুমের ঘোরেই ফোন রিসিভ করা মাত্রই বলে উঠল, এখনো বের হসনি সময় তো হয়ে এলো। ওর কথাতেই মনে পড়ে গেল আজ তো সিওয়াইবির ট্যুর রয়েছে। নির্ধারিত সময় সকাল ৯টা। দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে সবাইকে ফোন দিতে লাগলাম। এদিকে সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। কেউ কারো অবস্থান সম্পর্কে তখনো জানি না। একের পর এক ফোন আসছে আমরা বের হয়েছি, আপনারা সবাই কোথায়? দেখতে দেখতে ৯টা বেজে ৫০ মিনিট মোটামুটি সবাই উপস্থিত। আর এই উপস্থিতিকে নিশ্চিত করেছে সিওয়াইবি ইবির দপ্তর সম্পাদক ত্বকি ওয়াসিফ। কোনো কাজ দেওয়া মাত্রই সম্পন্ন করাই তার কাজ। ছেলেটির গুণ বলে শেষ করা যাবে না। এদিকে সিওয়াইবির সদস্য রওফুল্লাহ তখনো ঘুমে। ফোনকলে জাগিয়ে দিলেন সভাপতি, যদিও তার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ৩ মিনিট দেরি হয়েছে। তখনো এসে পৌঁছাতে পারেনি আরেক সদস্য আবদুুল্লাহ আল নোমান। যখন ক্যাম্পাস থেকে বাসটি কুষ্টিয়া শহরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়, এমন সময় নোমান এসে হাজির। অবশেষ ক্যাম্পাস থেকে ১৮ জন সদস্য সবাই উপস্থিত।

এতক্ষণ বলছিলাম কনজ্যুমার ইয়ুথ বাংলাদেশ (সিওয়াইবি) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখার শাখার কথা। এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী অরাজনৈতিক সংগঠন। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ ও ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা তরুণ ভোক্তাদের সংগঠন। এই স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়েই সিওয়াইবি ইবি শাখার উদ্যোগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক দিনের আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন করে। স্থানটি ছিল কুষ্টিয়া জেলার শেষ ও শুরুতে। পাবনার এই অনিন্দ্যসুন্দর স্থানটিতে তিনটি দর্শনীয় এক চোখে একবার তাকাতেই ফুটে শতবর্ষী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ। যে এই খানে আসবে এই স্থানটির প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়ে পড়বে। এক দিনের এই ভ্রমণে অংশগ্রহণকারী ছিল ২১ জন সদস্য, যার মধ্যে ১৮ জন ক্যাম্পাস থেকে বাকি ৩ জন কুষ্টিয়া থেকে আমাদের সঙ্গে মিলিত হয় সুলতান, নাফিস ও আবদুল্লাহ। এই যাত্রায় প্রধান মেহমান হিসেবে ছিলেন ইবির বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব দানকারী ইয়াশিরুল কবীর সৌরভ। এ ছাড়া উপস্থিত থেকে এই যাত্রা প্রাণবন্ত করেছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিব হাসান ও কুলছুম, সদস্য মোহন রায়, ইদুল, জাবিদ, মামুন হোসেন, রাকিব হাসনাত, মেহেদি, মোয়াজ্জেম, মুহাম্মাদ আলী ও তারুণ। তারা সবাই মিলে দিনটিকে আনন্দ প্রিয় করে তুলেছিল।

ক্যাম্পাসে থেকে বাস চলছে শহরের পানে, সকালের নরমণ্ডতীব্র রোদ সঙ্গে হালকা বাতাসের ছন্দে মুহূর্তেই ভিন্ন এক পরিবেশে রূপান্তরিত হলো। ভাঙা স্বরের গান ও গল্পে ধীরে ধীরে আমরা কুষ্টিয়া শহরসংলগ্ন বটতৈল এলাকায় এসে পড়লাম। সেখান আমরা সবাই নেমে পড়লাম, এদিকে দুজন সদস্যও যুক্ত হলো আমাদের সঙ্গে।

সেখান থেকে ইজিবাইকে ছুটলাম পোড়াদহ জংশনের দিকে, মিনিট-বিশের মধ্যেই এসে পড়লাম সেখানে। এখানে নেমেই দেখি এক লালনভক্ত গায়ক। তখনো ট্রেন আসতে ৩০ মিনিট লেট। এর ফাঁকে আমরা তার থেকে দুটি লালনসংগীত শুনে নিলাম। সেখান থেকেই মূলত শুরু ২৬ তারিখে আনন্দ ভ্রমণের মূল আকর্ষণ। যেখানের আকর্ষণগুলো পরিকল্পনাহীন ছিল, নতুন কিছুর মাধ্যমে যাতে সবাই উপভোগ করে দিনটি এটাই ছিল সেদিনের মূল লক্ষ্য। এরপর অপেক্ষার পালা খুলনা থেকে ছেড়ে আসা কপোতাক্ষ ট্রেন এসে হাজির। সবাই ট্রেনে উঠে পড়লাম।

এরপর যে যার মতো গল্পে মাতোয়ারা, সবার মনেই আনন্দের ছাপ লক্ষ করা গেল। কিছু সময় পর মিরপুর স্টেশনে এসে পড়লাম। সেখান থেকে আরেক সদস্য সুলতান আমাদের সঙ্গে মিলিত হলো। ৪০ মিনিট পর আমরা পাকসী/হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেলওয়ে স্টেশনে এসে উপস্থিত। সেখানে নামার পর একদিকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখছে আর স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি করে নিচ্ছে নিজেকে।

মুহূর্তটি শেষে আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে এলাম। এসেই প্রমত্ত পদ্মার বুকে নৌকাপথের যাত্রাকে স্মরণীয় করতে ইচ্ছে সবার। যদিও এ সময় নদীর যৌবন হারিয়ে মৃতপ্রায়, বর্ষার সময় সে আবার উত্তাল উন্মাদনায় নিজের ভরা যৌবনের প্রভাবে ভাসিয়ে নিয়ে চলে অনেকের বসতভিটে। যাই হোক সে গল্প অন্যদিন। এর আগে অনেকেই পদ্মার ওপর বয়ে চলা হার্ডিঞ্জ ও লালন শাহ সেতু দিয়ে অনেকবার চলাচল করলেও, বাস্তবে কাছ থেকে গিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা সবার ছিল না। ইচ্ছে থেকেই হার্ডিঞ্জ, লালন সেতু ও রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেখার জন্য এই আয়োজন। সে থেকেই পুরো একটি নৌকা নিজেদের করে নিলাম। এরপর দুই ঘণ্টারও বেশি সময় সেখানে কাটালাম। পাশেই লালন শাহ সেতু, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র এক পলকেই দেখা যায়। এই দৃশ্যটিই সবার মনকে কেড়ে নিয়েছে। সবাই সবার মতো করে নিজেদের সেই স্থানের স্মৃতিকে বন্দি করে নিল।

ছুটে চললাম রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে, সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নতুনত্ব যোগ হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল রাশিয়ার একটি অংশ। কারণ এখানের অধিকাংশই রাশিয়ান নাগরিক। তাদের মাধ্যমেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তৈরি হচ্ছে।

এদিকে সবাই ক্ষুধার্ত দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। এরপর ভিন্নধর্মী এক মিষ্টান্নের স্বাদ উপভোগ করলাম। অল্পদামে মানসম্মত মিষ্টি পেয়ে সবাই খুশি, যা সবার নজর কেড়েছে। মিষ্টি শেষে পান পর্বকে উপহার দিয়েছে সিওয়াইবি ইবি শাখার গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক মেহেদী হাসান রিয়াজ। একটি কথা না বললেও নয়, পাকসী স্টেশন থেকে রূপপুরের এ সময়টুকু সবাই হেঁটেই এসেছিল। এটি ছিল ক্ষুধাতুর পেটে কষ্টার্জিত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

দেখতে দেখতে বিকেল ঘনিয়ে আসছে, সময় সংকুচিত হচ্ছে। রূপপুর থেকে আবার আমরা পাকসীতে এসে হাজির। আবারও ট্রেনের অপেক্ষা, অপেক্ষারত এ সময় সবাই গল্প ও সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিল। বিশেষ করে সিওয়াইবি ইবি শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কুলছুম আক্তার তার কথা না বললেই নয়। সে একজন মেধাবী, কর্মঠ ও সব কাজের কাজী। সেই ছিল ওইদিনের একমাত্র মেয়ে। বাকিরা বিভিন্ন কাজে আসতে পারেনি। সেই একমাত্র যে সবচেয়ে বেশি ছবি উঠিয়েছে। সিওয়াইবি ইবি পরিবারের সবার কাছে প্রিয় তিনি।

এরপর সেখান থেকে আবার পোড়াদহ এলাম। এখান থেকে ইজিবাইকে করে কুষ্টিয়া। তারপর ক্যাম্পাসের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য সিট ধরে রাখলাম। তখন সময় সন্ধ্যা ৭টা। বাস ছাড়ার সময় সাড়ে ৭টা, এর ফাঁকে এ সময়টুকু কুলছুমের গান ও হালকা নাশতার মধ্যে কাটিয়ে দিলাম। সারা দিনের সবার গল্প, অভিজ্ঞতা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু মুহূর্তের মধ্যে আমরা ক্যাম্পাসে এসে পড়লাম। তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে যে যার রুমে চলে এলাম।

ছোট্ট ট্যুরে আনন্দের পাশাপাশি নতুন এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম, যা এই ট্যুরের সুন্দর একটি শিক্ষণীয় বিষয়। যেখানে প্রত্যেকের অসাধারণ ধৈর্য ও একত্র থেকে কোনো কাজ করার মধ্যে ভালো ফলাফল আসে, সেটা সেদিন আমরা পেয়েছি। এর পেছনে সিওয়াইবি ইবি শাখা সভাপতি গোলাম রব্বানীর দক্ষতা সেদিন সবাই লক্ষ করেছে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো একদিনে ট্যুরে বাস, ট্রেন, নৌকা ও ইজিবাইকের সমন্বয়ে ঘটেছিল। নতুন কিছু শেখা, যেকোনো পরিবেশে আনন্দ খুঁজে বের করার অনন্য দৃষ্টান্ত ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখটি ছিল। ছিল কিছু না বলা গল্পও, সব মিলিয়ে স্মৃতিময় একটি মুহূর্ত পেয়েছিলাম আমরা। এভাবেই একটি দিনের সমাপ্তি ঘটেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close