কে এম মাসুম বিল্লাহ

  ০৭ নভেম্বর, ২০২২

আলী আদনানের ‘আনন্দ পাঠশালা’

বিজ্ঞান বলে একটা মানুষের ব্রেইন ডেভেলপ হয় পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত। এ সময় সঠিক শিক্ষা একজন শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। বলা হয়ে থাকে একজন মানুষের নীতি নৈতিকতার ভিত তৈরি কিংবা আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী ছোট সময় থেকেই ব্যাড প্যারেন্টিং কিংবা ব্যাড টিচিংয়ের শিকার হয় যা কিনা তাদের পরবর্তী জীবনে প্রভাব রাখে। আর এসব চিন্তাভাবনা থেকেই আদর্শ মানুষ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন একজন তরুণ, নাম তার আলী আদনান।

‘আনন্দ পাঠশালা’ তার ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ। যেই পাঠশালার মাধ্যমে আলো ছড়াচ্ছেন কুষ্টিয়া শহরে। অন্য পাঁচটি সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলেও ‘আনন্দ পাঠশালায়’ পড়ালেখা ও খেলাধুলার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকে একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক গুণাবলি, আত্মনির্ভরশীলতা, সহযোগিতার মনোভাব তৈরি করা, পিতা-মাতা ও গুরুজনদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা তৈরি করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আলী আদনানের মতে বিদ্যালয় মানেই হচ্ছে শেখা, সেখানে শুধু একাডেমিক শিক্ষা থাকবে এমন নয়, এর পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে বাহ্যিক শিক্ষা প্রদান করা- যার মাধ্যমে সে মানবিক গুণাবলির অধিকারী হবে, নিজে স্বাবলম্বী হতে শিখবে। ব্যতিক্রমী এই পাঠশালা এরই মধ্যে অভিভাবক ও এলাকার মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। চলতি বছর মে মাসে চালু হলেও মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আনন্দ পাঠশালা অভিভাবকদের কাছে পছন্দের শীর্ষে। আনন্দ পাঠশালা এমনই এক স্কুল যেখানে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসার জন্য মুখিয়ে থাকে এমনকি শুক্রবার বন্ধের দিনও তারা স্কুলে আসার জন্য অভিভাবকের কাছে বায়না ধরে। ছোট সবুজ একটা মাঠ। মাঠের চারপাশে জানা-অজানা বাহারি রঙের ফুলের গাছ। পাশেই বাকবাকুম স্বরে ডাকছে এক ঝাঁক কবুতর। ঠিক যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার পটভূমি। যা কিনা বিদ্যালয়টিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। এরকম নান্দনিক পরিবেশের মাঝখানে সাদা একটা বাড়ি। ভেবে দেখুন, বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকছে একজন অভিভাবক ও তার মেয়ে। মা যখন তার পা থেকে স্যান্ডেল খুলে রাখবে ঠিক তখনই ছোট্ট মেয়েটি মায়ের স্যান্ডেল নিজ হাতে নিয়ে জুতা রাখার বাক্সে রেখে দিল। অর্থাৎ এই ছোট কাজটির মাধ্যমে ছোট বয়সে বাচ্চাটি একসঙ্গে দুটি শিক্ষা পেল। তার প্রথম শিক্ষা হলো বাবা-মা কিংবা গুরুজনদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা। যা কিনা আমাদের সমাজে এখন খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না, বাচ্চাটির দ্বিতীয় শিক্ষাটি হলো নিজে স্বাবলম্বী হতে শেখা যেটি তার ভবিষ্যৎ চলার পথকে সহজ করে দিতে পারে। আনন্দময় পরিবেশে বিভিন্ন বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের আত্মনির্ভরশীল হতে সেখানো হয় আলী আদনানের আনন্দ পাঠশালায় যার মধ্যে আছে জামা কাপড় কাচা ও পরিষ্কার করা শেখানো, জামা কাপড় ভাঁজ করা ইত্যাদি। কীভাবে বই গুছিয়ে রাখবে, কীভাবে দাঁত ব্রাশ করবে, হাত-পা পরিষ্কার রাখবে, বাগান পরিষ্কার রাখবে ইত্যাদি হাতে-কলমে মজার ছলে শেখানো হয়। এমনকি রাস্তা পারাপারের বাস্তব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই পাঠশালায়।

স্কুলের চারপাশে মনোরোম সুন্দর পরিবেশ, স্কুল মাঠের চারদিকে বিভিন্ন ধরনের ফল ফুল গাছের সমারোহ, ঠিক যেন এক বাংলো বাড়ি। মাঠের এখানে সেখানে পরে আছে বিভিন্ন রঙের ঘুড়ি, খেলনা গাড়ি, নানা কারুকার্য। দেখে মনে হতে পারে হয়তো কোনো শিশু পার্ক। এখানে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করা হয় নানা মজার মজার মাধ্যমে। যা দিয়ে বাচ্চাদের আকৃষ্ট করা হয়, যেমন- দেখা গেল ক্লাসের ফাঁকেই একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হলো, সে তার সহপাঠীদের প্রশ্ন করছে। কিংবা স্কুলের মাঠে ছোটখাটো একটা বাজার বসানো হলো, যেখানে শিক্ষার্থীদের কেউ সবজি বিক্রি করছে, কেউ দামাদামি করছে, কেউ নিক্তির মাধ্যমে সবজি মেপে দিচ্ছে। এভাবেই মজার ছলে শেখানো হচ্ছে বিভিন্ন সবজির নাম ও তাদের পুষ্টিগুণ! হঠাৎ করেই আবার চড়ুইভাতির আয়োজন, সবাই আনন্দের সঙ্গে সেখানে অংশ নিচ্ছে। কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কখনো মৃৎশিল্পের প্রদর্শনী হচ্ছে সেখানে শিক্ষার্থীদের মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিস প্রদর্শন করা হচ্ছে। কিংবা আয়োজন করা হচ্ছে মৌসুমি বাহারি ফল উৎসব। যেখানে বিভিন্ন ফল পরিচিতি ও তাদের পুষ্টি গুণাগুণ তুলে ধরা হয়, এছাড়াও ফল উৎসবে সহপাঠীরা একে অন্যকে ফল পরিবেশন করে থাকে। যার মাধ্যমে ছোট বয়সেই সামাজিকতা, আন্তরিকতা ও পারস্পারিক সৌহার্দ্য বিনিময় শিখছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। আনন্দ পাঠশালায় বাচ্চাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি শেখানোর জন্য নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। শিক্ষার্থীদের মানবিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের দিয়েই দান করানো হয় গরিব-দুঃখী মানুষদের। ছোটবেলা থেকেই যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যকে সহযোগিতা করার মনোভাব তৈরি হয় সেজন্য এমন পদক্ষেপ। এখনকার শিক্ষার্থীদের বড় একটা সমস্যা হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত হওয়া। এছাড়াও ঠিক সময়ে খেতে না চাওয়া, পড়তে না চাওয়াও সাধারণ সমস্যা। শিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি দূর করতে আনন্দ পাঠশালায় নেওয়া হয় বিভিন্ন পদক্ষেপ, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গল্পের ছলে কাউন্সিলিং করানো হয়। অভিভাবকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হয় এবং প্যারেন্টিং বিষয়গুলো তাদের বুঝিয়ে বলা হয়ে থাকে, এছাড়াও সময়মতো খেতে না চাওয়া কিংবা পড়তে না চাওয়ার এসব সমস্যা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত সমাধান নিয়েও আলোচনা করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করানো হয় যাতে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটতে পারে। গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে স্কুলের এমন কার্যক্রমে খুশি অভিভাবকরাও। সচেতন অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য আনন্দ পাঠশালাকে বেছে নিচ্ছেন। ভারতীয় নায়ক আমির খানের বিক্ষ্যাত থ্রি ইডিয়টস মুভির চরিত্র ফুংসুক ওয়াংডুকে যেমন শিক্ষার্থীদের জন্য গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে ব্যতিক্রমী একটি বিদ্যালয় চালাতে দেখা যায়, ঠিক তার বাস্তব চরিত্রই যেন কুষ্টিয়ায় আনন্দ পাঠশালার আলী আদনান। যিনি কিনা ব্যতিক্রম চিন্তা করতে ভালোবাসেন, যিনি স্বপ্ন দেখেন প্রতিটা শিশু ছোটবেলা থেকেই সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে, কোনো শিশু যাতে ব্যাড প্যারেন্টিং কিংবা ব্যাড টিচিংয়ের শিকার না হয়। আলী আদনান দীর্ঘদিন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত সৃজনী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকতা করেন। এছাড়াও তিনি সাতক্ষীরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ ও আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে এ বছরের মে মাসে প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বপ্নের ‘আনন্দ পাঠশালা’। শিশুদের নিয়ে কাজ করার মাঝেই তিনি তার জীবনের আনন্দ খুঁজে পান। স্বপ্ন দেখেন আলোকিত একটা বাংলাদেশের। আনন্দ পাঠশালার স্লোগান হলো ‘বড় হওয়া ভালো, ভালো হওয়া আরো বড়’। অর্থাৎ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠিত হওয়া ভালো, কিন্তু এর থেকেও বড় হলো নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এরই মধ্যে আনন্দ পাঠশালার কার্যক্রম নজরে এসেছে স্থানীয় প্রশাসন ও অনেক সচেতন মহলের। আর আনন্দ পাঠশালা এমন ব্যতিক্রমী কার্যক্রমের কারণে এরই মধ্যে এর প্রতিষ্ঠাতা আলী আদনান অর্জন করেছেন জাতীয় পুরস্কারও। প্রতিটি জেলা/উপজেলাতে এ ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্যও অভিভাবকদের কাছ থেকে অনুরোধ আসছে আনন্দ পাঠশালার স্বপ্নদ্রষ্টা আলী আদনানের কাছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close