ড. জগৎ চাঁদ মালাকার

  ২৮ মার্চ, ২০২২

ধানের সমলয়ে চাষাবাদের গুরুত্ব

বাংলাদেশের আবহাওয়া মাঠফসল, ফল ও শাকসবজি চাষের খুবই উপযোগী। আমাদের দেশে রয়েছে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন-প্রখর সূর্য়ের আলো, উর্বর কৃষিজমি, ভালো সেচব্যবস্থাপনা, বৃষ্টিপাত। এ ছাড়া রয়েছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ষড়ঝতুর বাংলাদেশ। অর্থাৎ যেকোনো ফসল সফলভাবে উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশের কৃষি ক্রমেই খরপোষ কৃষি বা স্বনির্ভর কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে এ দেশে বর্তমানে ড্রাগন, মাল্টা, কমলা, স্ট্রবেরি, কফি, কাজুবাদাম, মেলন ইত্যাদি সফলভাবে চাষ করা হচ্ছে। বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বালাইয়ের বালাইনাশকের প্রতি সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। গবাদিপশু হাঁস-মুরগি ও মাছের ক্ষতি হয়। উপকারী পোকামাকড় ও জীব মারা যায়। পোকামাকড়ের পুনরুৎপত্তি হয়। মাটির অণুজীব মারা যায়। খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়, দূষিত হয়। বালাইনাশকের অবশেষ ক্রিয়া দীর্ঘদিন থাকে। আইপিএমের আলোকে মাঠফসল, বসতবাড়ির সবজির ও ক্ষতিকর পোকা ও রোগের সমন্বিত ব্যবস্থাপনাগুলো :

১. জৈবিক ব্যবস্থাপনা : উপকারী পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য জমিতে এলোপাতাড়ি বালাইনাশক ব্যবহার না করা।

২. বালাই সহনশীল জাতের চাষ : বিএআরই বেগুন-৭, ৮, বেগুনের মাজরা পোকা সহনশীল, কাঁটাযুক্ত, লম্বাটে বেগুনে পোকা কম লাগে।

৩. আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি : সুস্থ বীজ ও চারা রোপণ, শস্য পর্যায় অনুসরণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ পুড়ে ফেলা, সঠিক দূরত্বে লাগানো, সমকালীন চাষাবাদ, পানি ব্যবস্থাপনা, সার ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত মাঠ জরিপ, বিকল্প পোষক ধ্বংস করা, গন্ধযুক্ত ফসলের আন্তফসল আবাদ, ফাঁদ ফসলের চাষা করা।

৪. যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা : হাত জাল দিয়ে পোকা ধরা, বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার, ডালপোতা, ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার, ডিম গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করা, আক্রান্ত ডগা, ফল সংগ্রহ করে পুঁতে ফেলা, বাগিং করা, শুকনো ছাই দেওয়া, মশারি দিয়ে ঢেকে দেওয়া, পরিষ্কার পানি ¯েপ্র করা, জোড় কলম করা-বনবেগুন+বেগুন, সাবানের গুঁড়া+ পানি ¯েপ্র করা।

৫. বালাইনাশকের যুক্তিসংগত ব্যবহার : রোগের আক্রমণ বেশি হলে (ক) উদ্ভিজ্জ-নিমতৈল, নিমবীজের শ্বাসের চূর্ণ, নিশিন্ধা, বিষকাটালি, মেহগনির বীজ, পাটবীজ, তামাক পাতা। (খ) রাসায়নিক-সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসাবে-কম স্থায়ী, স্পর্শ, প্রবাহ বিষ ব্যবহার কর।

উপকারী পোকামাকড় ও জীবের বংশবিস্তার এবং সংরক্ষণ :

বন্ধু পোকামাকড় সংরক্ষণ ও লালনপালন (বংশবিস্তার) পদ্ধতিগুলো উপকারী পোকামাকড় সংরক্ষণের প্রধান উপায় হলো জমিতে এলোপাতাড়ি কীটনাশক ব্যবহার না করা। উপকারী পোকামাকড় রঙিন ফুলজাতীয় সবজিতে আশ্রয় নিয়ে থাকে। জমিতে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ হলে তখন এই উপকারী পোকামাকড়ই ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

১. চিটাগাং পদ্ধতি বা আইল ফসলের চাষ : জমির আইলে রঙিন ফুল হয় এমন সবজি (বিশেষ করে বরবটি, শিম, করলা) চাষ করলে সেখানে বিভিন্ন প্রকার বন্ধু পোকার আশ্রয়স্থল তৈরি হয়। এতে করে বন্ধুপোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তখন জমিতে শত্রু পোকার আক্রমণ হলে এসব বন্ধু পোকা জমির শত্রু পোকা খেয়ে জমির ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

২. চায়না পদ্ধতি : ফসল তোলা বা কাটার পর পরই যদি জমির আইলে কিছু খড় বিছিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে উপকারী পোকামাকড় সেখানে আশ্রয় নেবে এবং এতে করে তাদের বংশ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এই পদ্ধতিকে চায়না পদ্ধতি বলে।

৩. বুস্টার পদ্ধতি : এই পদ্ধতির জন্য প্রথমে ৪/৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে বাঁশ নিয়ে বাঁশের ওপর দিক থেকে একটি গিঁটের নিচেই ১ ইঞ্চি / ১ ইঞ্চি পরিমাণ কেটে নিতে হবে। কাটা অংশের চার পাশে আঠাযুক্ত পদার্থের প্রলেপ দিতে হবে। আঠা যাতে করে শুকিয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বাঁশের খুঁটির মাথায় টিনের কৌটা দিয়ে এমনভাবে ঢাকনি দিতে হবে যেন ছিদ্র দিয়ে বাঁশের ভেতর পানি না ঢুকতে পারে। খেত থেকে পোকার ডিমের গাদা পাতাসহ সংগ্রহ করে বাঁশের কাটা অংশ দিয়ে বাঁশের ভেতরে ফেলতে হবে। ডিমগুলো যদি পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে কদিন পর বাঁশের ছিদ্র পথে বোলতা বেরিয়ে জমিতে ছড়িয়ে পড়বে আর যদি পোকার ডিম পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত না হয়, তবে তা থেকে ক্ষতিকর পোকার কীটা বের হয়ে যাওয়ার সময় বাঁশের ছিদ্রের চারপাশে দেওয়া আঠায় আটকে মারা যাবে। এত করে বন্ধু পোকার সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এই পদ্ধতিতে উপকারী পোকামাকড় সংখ্যা বাড়ানো যাবে।

৪. পলিব্যাগে পোকা পালন করা : এই পদ্ধতিতে পোকার ডিম সংগ্রহ করে পলিব্যাগে রাখতে হবে। পলিব্যাগে পানি ভেজানো তুলা ঢুকিয়ে দিতে হবে। ডিম ফোটার পর যদি দেখা যায় তা উপকারী পোকা তবে তা জমিতে ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি দেখা যায় ক্ষতিকর পোকা, তবে তা মেরে ফেলতে হবে। এইভাবে বন্ধু পোকা পালন করে সংখ্যা বাড়ানো যায়।

৫. এলোপাতাড়ি কীটনাশক ব্যবহার না করা : বেশির ভাগ উপকারী পোকামাকড় ফসলের ওপরের দিকে থাকে বিধায় এলোমেলো কীটনাশক ব্যবহার করলে উপকারী পোকামাকড় মারা যাবে। তাই এলোপাতাড়ি কীটনাশক ব্যবহার না করা এতে উপকারী পোকামাকড় সংখ্যা বাড়ানো করা যাবে।

সমলয়ে চাষাবাদ

বাংলাদেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মিটানোর নিশ্চয়তা বিধান করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২ এ ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষি প্রসারের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে সব মানুষ বিশেষ করে অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, দরিদ্র জনগণ ও শিশুদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারসহ বছরব্যাপী নিরাপদ, পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে ক্ষুধার যন্ত্রণার অবসান ঘটানো নিশ্চিত হবে।

সমলয়ে চাষাবাদের গুরুত্ব

১. কৃষকদের মধ্যে সমবায়ী মনোভাব গড়ে তোলা। ২. স্বল্প সময়ে বোরো ফসল রোপণ ও কর্তন করা। ৩. বোরো ফসল উৎপাদনে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি করা। ৪. বোরো ফসল চাষে আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রারণ করা। ৫. বোরো ফসল চাষে শ্রমিক সাশ্রয় করে উৎপাদন খরচ কমানো। ৬. বোরো ফসল চাষের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে কৃষকদের সম্যক ধারণা প্রদান করা। ৭. কর্মসূচির আওতাভুক্ত ও পার্শ্ববর্তী কৃষকদের কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার এবং সমলয়ে চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করা।

উপসংহার : এ ছাড়া সমন্বিত পদ্ধতিতে পোকা ও রোগ দমনের সহজ প্রাপ্য পদ্ধতিগুলোর সমন্বয় করা হয় এবং গাছের বৃদ্ধির কোন পর্যায়ে কোন পোকা ও কোন অংশে কোন পোকা বা রোগ আক্রমণ করে, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিলে বালাইয়ের আক্রমণ হার সর্বনিম্ন থাকে এবং ফসলের উৎপাদন আর্থিকভাবে ক্ষতিকর হয় না। শত্রু পোকার সংখ্যা কমিয়ে/নিয়ন্ত্রণে রাখা। উপকারী পোকামাকড়ের সংখ্যা বাড়ানো।উৎপাদন খরচ কমিয়ে রাখা। কীটনাশকের ব্যবহার কমানো। পরিবেশের ভারসাম্য রজায় রাখা। কীটনাশক শুধু ক্ষতিকর পোকামাকড় মারে না, এর ব্যবহারে উপকারী পোকা ও মাকড়সাও মারা যায়। এ ছাড়া বালাইনাশক মানুষের জন্যও নিরাপদ নয়। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানুষকে রোগাক্রান্ত করে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি বালাইনাশকের বিষাক্ততার কিছু অংশ উৎপাদিত ফসল ও খাদ্যের মধ্যে থেকে যায়। এ ছাড়া বালাইনাশকের দ্বারা পুকুর ও নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে জলজপ্রাণীর জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। বাতাস দূষিত করে। মাটির অণুজৈবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। আইপিএমের আলোকে মাঠফসল, বসতবাড়ির সবজির ও ক্ষতিকর পোকা ও রোগের ব্যবস্থাপনা নিলে বালাইয়ের আক্রমণ হার সর্বনিম্ন থাকে এবং ফসলের উৎপাদন আর্থিকভাবে ক্ষতিকর হয় না এবং নিরাপদ কৃষি উৎপাদন সম্ভব।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকাণ্ড১২১৫

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close