মোস্তাফিজুল হক

  ৩০ নভেম্বর, ২০১৯

পালকছেঁড়া পাখি

দোয়েলের কিচিরমিচির আর কিছুক্ষণ আগেই খোঁয়াড় থেকে মোরগের হাঁকডাকে অপুর ঘুম ভেঙে যায়। জানালা খুলতেই গন্ধরাজের মিষ্টি ঘ্রাণ অপুকে বিমোহিত করে। কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁকে সোনালি রঙের ভোরের সূর্য এসে অপুর চোখে আজ অজানা কোনো এক নতুন দিনের হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। মা প্রতিদিনের মতোই নাশতা তৈরির কাজে ব্যস্ত।

কিছুক্ষণ পর মা এসে বললেন, অপু, বিছানা ছেড়ে এবার হাতমুখ ধুয়ে নাও। গরম-গরম লুচি আর পায়েস খেয়ে পড়তে বসো। সকালের পড়াটা বেশি মনে থাকে, বাবা। অপু দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে বাগানে ছুটে গেল। এটা তার রুটিনওয়ার্ক। বাগানে গিয়ে দেখতে পেল আজ অনেক বেশি গন্ধরাজ ফুটেছে। ফুলগুলোর মিষ্টি ঘ্রাণ যেন আজ ওকে বেশিক্ষণ বাগানে থেকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

অপু খুশি মনে ফুলগুলোকে আলত পরশে ছুঁয়ে দেখছিল। হঠাৎ সে খেয়াল করল বড় গন্ধরাজ গাছটার নিচে অদ্ভুত সুন্দর একটা পাখি পড়ে আছে! সাতরঙা পালক! লাল-পান্নায় গড়া অপূর্ব তার ঠোঁট! এত্ত সুন্দর পাখি সে আর আগে কখনো দেখেনি! কী মায়াবী তার চোখ! পাখির প্রতিটা পালক যেন বার্নিশ করা! কিন্তু এ কী! পাখিটার দুটো বড় পালক যে ছেঁড়া! পাশেই ধবধবে সাদা অনেক বড় একটা গন্ধরাজ ফুল পড়ে রয়েছে! এত ভোরে পাখিটার পালক আর ফুল কেইবা ছিঁড়ল! পাখিটাও কেনইবা অপুকে দেখে উড়ে যাচ্ছে না! অপুর মনে নানা প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। অপুর মনে হচ্ছে, পাখিটা যেন তার কাছে আশ্রয় চাচ্ছে। অপু কোমল হাতে পাখিটাকে উঠিয়ে নিল। গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। আদর পেয়ে পাখিটা বলে উঠল, ভাইয়া, তুমি খুব ভালো। এবার অপু আরো বেশি অবাক হয়ে গেল! কী আশ্চর্য! এই অচেনা পাখি যে মানুষের মতোই কথা বলতে পারে! এবার পাখিটা আরো বলে উঠে, তোমাকে আমার দুঃখের কথাগুলো বলতে চাই। কিন্তু কথাগুলো তুমি কাউকে বলতে পারবে না। ঠিক আছে। বল। আমি কাউকেই বলব না। এবার পাখিটা বলতে লাগল, তুমি আমার কথা শোনে ভয় পেয়ো না, ভাই। আমি আসলে পাখি নই। তাহলে কী তোমার পরিচয়? আমি সাত আসমানের পরিরাজ্য থেকে এসেছি। আমাদের দলের আরো অনেকেই এ বাগানে গত রাতে এসেছিল। ওই রাজ্যের রাজকন্যা আমি। ভরা পূর্ণিমার রাতে আমরা আমাদের ডানা মেলে পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগানগুলোতে বেড়াতে আসি। আমরা কখনোই মানুষের ক্ষতি করি না। পরীদের মধ্যে কেউ মানুষের ক্ষতি করলে আমাদের মহারাজ তাকে কঠিন শাস্তি দেন। তাকে পরী থেকে পাখি বানিয়ে দেওয়া হয়। সে আর কখনোই পরী হতে পারে না। তাকে পাখি হয়েই উড়ে বেড়াতে হয়।

অপু এবার সব শুনে বলল, তাহলে তুমি কেন পাখি হয়ে উড়ে যাওনি? এবার পরিরাজ্যের রাজকন্যা বলল, আমার অপরাধ বেশি হয়েছিল। তাই আমার উড়বার পালক দুটো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। যত দিন না আমার নতুন পালক গজাবে তত দিন আমাকে এ গাছের নিচেই পড়ে থাকতে হবে। তুমি কী এমন অপরাধ করেছিলে যে, তোমার পালক ছিঁড়ে ফেলা হলো? আমি তোমাদের বাগানের সবচেয়ে সুন্দর গন্ধরাজ ফুলটা ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজেছিলাম। এটা কী এমন অপরাধ? অনেকেই তো না বলেই ফুল ছিঁড়ে নেয়। তা হতে পারে। কিন্তু আমাদের রাজ্যে ফুল ছেঁড়া ভীষণ অন্যায়। গাছের ফুল গাছেই সুন্দর। এবার পাখিটা বলল, মনে আছে তো? আমার এ ঘটনা কিন্তু তোমার মাকেও বলা যাবে না। তাহলে আমার মৃত্যু হবে। ঠিক আছে, বলব না। কিন্তু তুমি এভাবে এখানে পড়ে থাকলে তোমাকে যে বনবিড়াল বা যেকোনো হিংস্রপ্রাণী খেয়ে ফেলবে? এ জন্যই তো আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাইছি। লক্ষ্মী ভাই আমার, তুমি কি আমায় খাঁচায় পুষবে?

কিন্তু খাঁচায় পাখি পোষা তো ভালো নয়। তোমাকে খাঁচায় ভরে রাখলে মা আমাকে বকবেন। বাবাও ভীষণ রাগ করবেন। তুমি বলবে, এ পাখিটার পালক ছেঁড়া। উড়তে পারে না। এটার যেদিন নতুন পালক গজাবে সেদিন ছেড়ে দেব। ঠিক আছে। তাই হবে। মা ডাকছেন। অপু। বাবা। কই তুই? মায়ের ডাকে এবার অপু পাখিটাকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। কী রে অপু, পাখি ধরে এনেছিস কেন? সকালবেলাই তুই এ কী কাজ করেছিস? বনের পাখিদের খাঁচায় পুষতে নেই, বাবা। তুই এটাকে ছেড়ে দিয়ে আয়।

মা, এটা যে উড়তে পারে না! বাগানের গন্ধরাজ গাছের নিচে পড়েছিল। এই যে দেখো, এর সবচেয়ে বড় পালক দুটো ছেঁড়া! নতুন পালক গজালেই আমি এটাকে ছেড়ে দেব, মা। মা, তুমি বাবাকে একটা খাঁচা কিনে দিতে বলবে কিন্তু। এবার অপুর বাবা নামাজ শেষে ঘরে এসে দেখলেন, অপুর হাতে অপূর্ব সুন্দর একটা পাখি! এত্ত সুন্দর পাখি তিনি আর আগে কখনই দেখেননি। অপু, তুই এই পাখিটা ধরে এনেছিস কেন? বাবা, এটা উড়তে পারে না। এই দ্যাখো দুটো পালক ছেঁড়া। তুমি একটা খাঁচা কিনে দেবে, বাবা? আমি কথা দিচ্ছি, এটার পালক গজালেই ছেড়ে দেব। ঠিক আছে। কথা যেন ঠিক থাকে। পরে যেন মায়া না দেখাস। না বাবা, আমি সত্যিই ছেড়ে দেব। প্রতিদিন খাঁচার পাখিকে অপু নিয়ম মেনে খাওয়ায়। ধীরে ধীরে পাখিটার নতুন পালক গজাতে শুরু করল। এদিকে পাখিটাও অপুকে আনন্দচিত্তে গান শোনায়। কোনো পাখির গান-ই এতটা সুরেলা নয়। গান শোনে বাড়ির সবাই খুশি।

এদিকে পরিরাজ্যে রানিমা ভীষণ অসুস্থ, একমাত্র কন্যাকে শাস্তি দিয়ে রাজার মনেও শান্তি নেই। কিন্তু রাজ্যের নিয়ম ভাঙার ক্ষমতা রাজারও নেই। তাই কন্যার শাস্তি তুলে নিতে চাইলেও তা সম্ভব না। কেবলমাত্র যাদের ক্ষতি করেছে তাদের ভালোবাসা আর আদর-যতেœ যদি পাখিরূপী রাজকন্যার পালক গজায়, তবেই তার শাস্তি তুলে নেওয়া যাবে। তাই রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন তার কন্যার খোঁজ নিতে হবে। এদিকে অপুর পোষা পাখিটার প্রশংসা গাঁয়ের সব মানুষের মুখে মুখে। পাড়া-পড়শিরা মাঝে মাঝেই এসে পাখিটাকে দেখে যায়। তারা বলে কী মায়াবী পাখি। কতই না আবেগী সুরে গান গায়! তারা বলে, পাখিটাকে ছেড়ে দিও না অপু। অপুর বাবা বাইরে যাওয়ার আগে একবার পাখিটাকে দেখে যায়, আবার বাড়ি ফিরেই পাখিটার খোঁজ নেয়। এক দিন যিনি ছেলেকে পাখি পুষতে নিষেধ করেছিলেন, আজ সেই তিনিই খাঁচায় তালা লাগিয়ে চাবি নিজের কাছে রাখেন। অপু মনেমনে কষ্ট পায়। কাউকে কিছুই বলে না। এদিকে পাখিটাও জানতে পেরেছে যে, তার শাস্তি মওকুফ হয়েছে। কিন্তু কী আর করা যায় পরী পাখিটা আর অপু ভাবতে থাকে।

এক দিন রাতে সত্যি সত্যিই পাখিটা খাঁচা থেকে বের হয়ে পরীর আকার ধারণ করে। অপু তো সুন্দর পরীকে দেখে অবাক হয়ে যায়! অনেক দিন অপু ও পরী পাখি বন্ধু হয়েছিল। পরী অপুকে বলে, তুমি আমার সারা জীবনের বন্ধু হয়ে রইলে। কখনো প্রয়োজন পড়লে ডেক। অপুর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তবুও হাসিমুখেই বলল, বিদায় বন্ধু। কখনোই বাবা-মার হুকুম না মেনে ও নিয়ম ভেঙে কিছু করো না। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে পরিরাজ্য থেকে তার সাথীরা এসেছে তাকে নিতে। বিদায়বেলায় পরী বন্ধুটি বলে গেল, তোমার এই উপকারী মনটা এক দিন তোমাকে অনেক সম্মানিত করবে। ভালো থেকো বলেই পরীরা ডানা মেলে মিলিয়ে গেল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close