মো. শামীম মিয়া
গল্প
বাংলার জয়
রতনের মাথা, মা জননীর বুকে। মায়ের দুই চোখে, হিরার মতো দুই ফোঁটা জল চিকচিক করছে। বাবাহারা যুবক সন্তানকে কীভাবে সান্ত¦না দেবেন মা জননী? কী নির্মম নির্দয়ের মতো শয়তান জানোয়ার পাকিস্তানিরা রতনের বাবা রহমানকে কুকুরের মতো গুলি করে মেরে ফেলেছে। রহমানের অপরাধ, রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রতন সেদিন বাবার সঙ্গেই ছিল। রতনকে পাকিস্তানিরা কৌশলে আগেই বাঁধে, তারপর রতনের বাবা রহমানকে মেরে ফেলে। পৃথিবীর কোনো সন্তান এমনটি ভাবতে পারে? কেউ ভাবতে পারে না, মনটা বাধা দেয়, না-না-না এমনটি হতে পারেই না।
মা কাঁদেন, তার স্বামীর জন্য কাউকে বুঝতে দেন না। তবে গর্বের শেষ নেই, তার স্বামী একজন মুক্তিযোদ্ধা। মা জননী যে তার জীবন দেশের জন্য দিতে কণ্ঠাবোধ করবেন না, তা রতন জানে। তবে মায়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না। বাবা শহিদ হওয়ার পর থেকে হাসি নেই মা জননীর মুখে। রতন বুঝতে পারে, মা জননীর মুখ দেখে। মা জননী পাকিস্তানিদের ঘৃণা করেন। মা জননী স্বাধীন একটি মাতৃভূমি চান।
তবে মা জননীর প্রাণ রতন। রতনকে ছাড়া মা জননী একটা জীবন্ত লাশ। বাবা রহমান শহিদ হওয়ার পর, কেমন যেন হয়েছেন মা। রতনকে চোখের আড়াল হতেই দেন না। প্রায় সময় মায়ের মমতামাখা শাড়ির আঁচলে রাখতে চান। রতন বুঝতে পারে মা জননী আমাকে হারাতে চান না। মা যে বড় অসহায় আমি ছাড়া। মা জননীর এই পৃথিবীতে কেউ নেই। রতন ভাবছে আমাকে আমার বাবার শেষ কাজটুকু লাখো বাবার, লাখো সন্তানের সঙ্গে সমাপ্ত করতেই হবে। আজ রতন মায়ের বুকে মাথা রেখে বলল, যানো মা, আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। মা বলল, কেন রে বাবা? রতন বলল, মা-গো আমি হয়তো হতভাগা সন্তান, আমার সামনেই আমার বাবাকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলল। মা-গো বাবার মৃত্যুর সময় বাবার মুখে শেষ কথাটা আমাকে জ্বালাতন করে প্রতিটি মুহূর্তে। মা মুখখানা অন্যদিকে করে চোখের দুফোঁটা পানি মুছে বুকটিকে পাথর বানিয়ে বলে, কী কথা বাবা? আসলে বাবার মুখের শেষ কথাটা মা আগেই শুনেছে। বাবা রোজ রাতেই বলত, আমি যদি আমাদের দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে মারা যাই, অসমাপ্ত কাজগুলো আমার ছেলে রতন করবে। না জানার ভানে মা বলল, কী কথা বাবা? মুহূর্তেই রতনের চোখ পানিতে ভরে গেল। রতন বলল, মা-গো বাবার মুখে শেষ কথা ছিল জয় বাংলা, বালার জয়, নিশ্চয়। আরো বলেছিল বাবা আমাকে উদ্দেশ করে, বাবা রতন আমার দেশমাকে আমি তোর, তোর মতো দামাল যুবক সবার হাতে দিয়ে গেলাম। দেশমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোদের। মা শুধু কাঁদছে, মাও তো দেশমাকে কম ভালোবাসেন না। মায়ের তো বোঝার বাকি নেই ছেলে মাকে কী বলতে চায়?
রতন মাকে বলে, মা-গো, তুমি ভেবে দেখো একবার, তাদের কথা, যারা শহিদ মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, তারা কত মহান। তারা কত ত্যাগী, কোনো ধনদৌলত নয়, নয় নিজ স্বার্থ, দেশমা এবং দেশের মানুষের জন্য আরো হাজারো লাখো কাজের জন্য এই মহান ব্যক্তিবর্গের আত্মবলিদান। গৃহের টান, ছেলেমেয়ে, তাজা প্রাণ এগুলো যেন কিছুই নয় তাদের কাছে। সত্যি মা-গো, তারা কত মহান মহৎ। নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে দেশ তথা মানুষের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখেন। মা-গো তাই তো তারা অমর। তারা চিরজীবন্ত মা-গো বাবা মরেনি বাবা তো অমর। মা-গো তাই বাবা এবং শহিদ মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গর্ব আর হৃদয়জুড়ে স্ফীত অহঙ্কার। মা-গো, এই দেশ স্বাধীন করতে হলে আরো কিছু তাজা প্রাণের দরকার।
হঠাৎ মায়ের চোখ দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ আসে। মুহূর্তেই বুকটা ভিজে যায় মায়ের। মা তো বুঝেছে ছেলে মাকে কী বলবে? ছেলে যুদ্ধে যেতে চায়। মাও তো দেশকে তার মায়ের মতোই ভালোবাসে। মা ভাবছে আমি এক মা আরেক মাকে বাঁচানোর জন্য ছেলেকে কোরবানি দেবÑএটা আমার গর্ব, আমার অহঙ্কার। মা বুকটিকে পাথর করে, মুখে মমতামাখা রঙে বলল, বাবা রতন পারবে না বাবা তোর দেশমাকে বাঁচাতে? পারবে না বাবা রতন ওই শয়তান জানোয়ার পাকিস্তানিদের এই দেশ থেকে চিরদিনের জন্য তাড়াতে? রতন মাকে জড়িয়ে বলল, পারব মা-গো, পারব। শুধু একবার অনুমতি দাও মা। মা বলল, যা বাবা, যা, আজই যা, যুদ্ধে যা। বাংলার জয় না নিয়ে আমার সামানে আসবি না। বাবা মনে রাখবে, তুই তোমার মায়ের সম্মান বাঁচাতে যাচ্ছিস।
ঠিক হলো আজকেই রতন যাবে যুদ্ধে। রতন আজ তার বন্ধুদের খবর দিল। রতনের কথায় জীবন, জয়, বিজয়, শফিক, রফিক সবাই এলো রতনের বাড়িতে। আজ মাঝরাতে তারা যাবে যুদ্ধে। তবে তাদের প্রথমে যেতে হবে আমাদের পাড়া, তারপর জুমারবাড়ী। সেখানে কমান্ডার কুদ্দুছের বাড়ি। কুদ্দুছের স্ত্রীর কাছ থেকে তারা রতনসহ সবাই ঠিকানা নেয় আসলে তারা যাবে কোন পথে? সাঘাটা থানা দিয়ে গাইবান্ধায়। সেখানেই কুদ্দুছ কমান্ডার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা।
রতনরা বাড়িতে ফেরার আগেই মা রান্নাবান্না শেষ করেন। রতনসহ সবাই খাওয়ার পর্ব শেষ করেন। তারপর বিদায়ের পালা। রফিক, শফিক, জয়, বিজয়, জীবন মায়ের পায়ে সালাম করে বিদায় নেয়। এবার রতনের পালা। মায়ের বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছে। মা জননী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রতনের দিকে। সেই ছোট্ট রতন আজ যাচ্ছে দেশমায়ের জন্য যুদ্ধে। রতন এসে মায়ের পায়ে সালাম করে বলল, মাগো আমি যুদ্ধে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া করো মা? মনটাকে পাথর বানিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে হাসিমাখা মুখে তার একমাত্র সন্তানকে যুদ্ধে পাঠালেন মা। তার একমাত্র সন্তান রতন অবশ্যই বুঝেছিল তার মায়ের মনের কষ্ট বা মা জননী কতই না ভালোবাসে দেশমাকে। তারা কয়জনে এসে ৩ নম্বর সেক্টরে যোগ দিল। বেশ কদিন কেটে গেল। যত দিন যায়, তত ভয়াবহ দিন হয়ে যাচ্ছে। মায়ের আজ খুব চিন্তা হচ্ছে। তবে মা আর কাঁদে না। তবে একা একা থাকেন। সেদিন এক পথিককে মা জননী বলল, তার প্রাণের একমাত্র সন্তান কেমন আছে? পথিকটি, জলে ভেজা চোখে মাকে বলল, মা-গো তোমার সন্তান রতন কমান্ডার হয়েছে। মা-গো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দেশ স্বাধীন হবে দেখো। এই বলে পথিকটি চলে যায়। মা ঘরে গিয়ে রতনের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করলেন। দোয়া করলেন দেশমায়ের বুকে জন্ম নেওয়া সব সন্তানের জন্য। আরো একটি মাস কেটে গেল। মায়ের প্রাণ রতন আজও মায়ের বুকে ফিরে আসেনি। যুদ্ধ চলছেই।
আজ মায়ের বুকটা কেন জানি ধরফর করছে। এত দিন, এমন করেনি, আজ কেন জানি এমন লাগছে মায়ের। মায়ের মনে হলো রতনের কিছু হলো না তো? হঠাৎ মায়ের কানে ভেসে আসে জয় বাংলা, বাংলার জয়।
মা ঘর থেকে দরজায় ছুটে আসে হয়তো তার সন্তান রতনরা বিজয়ের পতাকা নিয়ে মায়ের কাছে আসছে। বাইরে এসে মা দেখেন এ তো জয়ের মিছিল। আমাদের দেশ স্বাধীন হলো। মা আলহামদুলিল্লা বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। এবার মা তার সন্তান রতনকে খুঁজছে। কোথায় রতন খোঁজে মা এবং মনে মনে বলে হয়তো রতন বিজয়ের মিছিলের মধ্যে আছে। মা মনে মনে বলে, এই মিছিল তো বিজয়ের মিছিল, শেষ নেই এর। তবে কোথায় খুঁজব আমার সন্তানকে? হঠাৎ মায়ের চোখ যায় জীবনের দিকে। জীবনের পাশে বিজয়ের পতাকা নিয়ে আছে রতন, রফিক, জয়, বিজয়, রফিক ও শফিক। তারা মায়ের দিকে আসছে সবুজের বুকে লাল বিজয়ের পতাকা নিয়ে। কত সুন্দর লাগছে তাদের। মনে মনে বলছে মা। চমকে গেলেন মা। মুহূর্তেই যেন মিশে গেল তারা। মা অনেক খুঁজলেন তাদের। মায়ের মন থেকে একটা প্রশ্ন এলোÑতাহলে ওরা কী শহিদ হলো? শহিদরা তো মরে না, ছায়া হয়ে থাকে। মায়ের মনটা আর মানছে না। মিছিলের বেশ কয়জনকে মা তার ছেলে রতনের কথা জিজ্ঞাসা করে। উত্তরহীন পথিকের দিকে মা তাকিয়ে থাকে এবং গুটি গুটি পায়ে বিজয়ের মিছিলের পিছে পিছে এগোতে থাকে মা। মা তো বুঝে গেছেন, তার ছেলে শহিদ হয়েছে। মা আর কাঁদেন না কেন না, মা তো ছেলের চেয়ে দেশকে বেশি ভালোবাসেন।
"