রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

মানসম্পন্ন বই জাতির জন্য সেরা উপহার

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে ভালো মানের প্রকাশনীর বই দরকার। বর্তমানে অনেক প্রকাশনীর ভিড়ে ভালো মানের বই পাওয়া সহজ নয়। বাংলাদেশে সবকিছু যেন ব্যবসাকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি প্রকাশনীর গুণগত মানের ভালো বইয়ের জন্য স্বচ্ছ পরিকল্পিত জবাবদিহিমূলক নিজস্ব সম্পাদনা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। ভালো মানের বই প্রকাশে সব প্রকাশনীর মান হতে হবে সেবাকেন্দ্রিক। বাংলার একুশে বইমেলা হোক সফলতার এবং ঐতিহ্যের বাহক। একটি ভালো বই হচ্ছে সঠিক পথ চলার বন্ধু। ভালো বই পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না। সুতরাং ভালো বই সে এক বিশাল বিষয়। তাই আসছে বইমেলায় আমরা আশা করছি ভালো ভালো বই। চাই মানসম্পন্ন বই প্রকাশ। যেহেতু ভালো বই পাঠককে আনন্দ দেয়, দেয় প্রশান্তি। কথায় বলে, আগে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী। কথাটি সর্বৈব সত্য। যদিও আমরা জানি যে, একজন শিক্ষিত মানুষের সর্বোত্তম বন্ধু হচ্ছে একটি ভালো মানের বই। আর যেহেতু একটি ভালো মানের বই একজন মানুষের সর্বোত্তম বন্ধু, তাই সেই বইটির ছাপার অক্ষরগুলো এবং ছাপানো অক্ষরের পাতাগুলো অবশ্যই ঝকঝকে-তকতকে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে। কেননা এগুলো যদি ভালো ও উন্নত মানের কাগজে ও ছাপার অক্ষরে না হয়, তাহলে সেই বইটি পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারবে না। আর পাঠকমহলে পৌঁছাতে না পারলে বইটি যতই ভালো মানের হোক না কেন, তা তো তখন কারোরই উপকারে আসতে সক্ষম হবে না।

তাই সর্বাগ্রে প্রকাশকদের উন্নত মন-মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে এবং ভালো ও উন্নত মানের বই ছাপানোর ব্যাপারে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও তৎপরতা থাকতে হবে। আমরা চাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রকাশকরা এবারের বইমেলায় সুন্দর ও উন্নত মানের কাগজে ঝকঝকে ও তকতকে ছাপার অক্ষরে সুন্দর সুন্দর বিষয়বস্তুর আলোকে লিখিত বই ছাপিয়ে উপহার দেবেন। বই মানুষের প্রকৃত বন্ধু। ভালো বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। একটি ভালো বই আজ ও আগামীর পথ প্রদর্শক। বই বর্তমানকে নিয়ে যায় ভবিষ্যতের দিকে। বইয়ের মাধ্যমেই আমরা অতীত জানতে পারি। বইয়ের মাধ্যমে আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হই। তাই একুশে বইমেলায় চাই সৃষ্টিশীল বই। যা বর্তমানের যুবসমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে অবদান রাখবে। বই হচ্ছে জ্ঞানের ভা-ার। যে যত বই পড়বে সে তত জ্ঞানার্জন করবে। বই আলোকিত করে মানুষকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় ভালো প্রকাশকের অভাবে আজ মানসম্মত বই প্রকাশ হচ্ছে না। সুতরাং এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। এমনকি বইমেলার সাহিত্য সংস্কৃতি উৎকর্ষ বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। দক্ষ ও পর্যাপ্ত সম্পাদকের অভাবে মানহীন বইয়ের প্রকাশনা পাঠকের সঙ্গে প্রতারণার নামান্তর। বাংলা একাডেমি ও পুস্তক প্রকাশকদের সমন্বয়ের সম্পাদক সৃষ্টির প্রয়াস একবার দেখা গেলেও এখন আর কার্যক্রম নিয়মিত নয়। তাই মানসম্মত বই প্রকাশের, মানসম্মত সম্পাদক সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত জরুরি। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে প্রয়োজন কৃষির বহিঃপ্রকাশ। চিন্তা-চেতনার বৈশ্বিক পরিবর্তন আনতে পারে শুধু বই।

এমনকি জাতির বিকাশ করার জন্য প্রয়োজন আলোকিত মানুষ। আর এজন্য রয়েছে বইয়ের মুখ্য ভূমিকা। ভালো মানসম্পন্ন বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন। আর মাত্র কয়েকটি দিন বাকি। এরপরই শুরু হচ্ছে কোটি বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা-২০২০। মেলা চলবে ২ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। লাখো মানুষের মিলনমেলা হলো এ বইমেলা। প্রতিটি বইপ্রেমী মানুষ, লেখক, প্রকাশক সবাই অপেক্ষায় থাকেন এ মাসটির জন্য। বই মানুষের পরম বন্ধু। বই মনের কথা বলে, জীবনের কথা বলে আর ঘুমন্ত চেতনাকে জাগ্রত করে, মস্তিষ্ককে করে শানিত। তাই বই সবারই প্রিয় এবং ভালোবাসার বিষয়, আবেগের বিষয়। প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয় কয়েক হাজার বই। গত বছর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের মতো। মেলায় স্টল থাকে ৬০০ থেকে ৭০০-এর মতো। তবে এর পরিধি বাড়ছে প্রতি বছরই। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বিগত বছরগুলোতে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানটিতে হতো এবার এটি কিছুটা সরে গেছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। বাড়ছে পরিধিও। গত বছরের তুলনায় এবার স্টল বরাদ্দ থাকছে আরো বেশি। স্বাভাবিকভাবেই সব লেখকও প্রত্যাশায় থাকেন বইমেলায় বই প্রকাশের জন্য। তাছাড়া বইমেলা উপলক্ষে বই প্রকাশও লেখকদের মনে যোগ করে এক অনাবিল আনন্দ।

তবে এ সময় বই প্রকাশের যে চাপ সৃষ্টি হয় তা সামাল দিতেই হিমশিম খান প্রকাশকরা। কেননা, শেষ মুহূর্তে এত বই প্রকাশ করতে গিয়ে প্রচ্ছদ, বর্ণবিন্যাস, ছাপা, বাঁধাইসহ সব স্থানেই তাদের পোহাতে হয় প্রচ- চাপ। বইয়ের মান নিয়েও অসন্তুষ্টি পোষণ করেন লেখক এবং পাঠকরা। প্রথমত প্রুফ রিডাররা হাতে অনেক কাজ থাকার ফলে দ্রুত সময়ে কাজ করে থাকেন। তখন বইয়ে থেকে যায় অসংখ্য ভুল। এছাড়াও রয়েছে বই চাপে না রাখাজনিত সমস্যা। স্বল্প সময়ে বই বাঁধাই করে সরবরাহের লক্ষ্যে মালিকরা বই বাঁধাই করার সঙ্গে সঙ্গেই সরবরাহ করে ফেলেন। অথচ বই বাঁধাইয়ের পর সর্বনিম্ন ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বই চাপে রাখা উচিত। এমনও দেখা যায়, লেখক প্রকাশ করতে চাইলেন ‘এ’ ক্যাটাগরির বই, আর সেখানে প্রকাশের পর দেখা গেল তা ‘সি’ ক্যাটাগরি কিংবা তার চেয়েও খারাপ। বইয়ের মানজনিত এসব সমস্যা থেকে বের হয়ে একেকটি মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করতে প্রকাশকদের যেমন সচেতনতা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন লেখকদেরও। কেননা লেখকরা যদি বইমেলার আগ মুহূর্তে বই প্রকাশ না করে তা কয়েক মাস আগে থেকে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তাহলে প্রকাশক যেমন স্বস্তিতে কাজ করতে পারেন তেমনি প্রতিটি ধাপে বইয়ের কাজও হয় সুন্দর। ফলে লেখক যেমন পাবে মনের মতো বই, তেমনি পাঠকদের হাতেও তুলে দেওয়া যাবে একেকটি মানসম্পন্ন বই। আসছে ১ ফেব্রুয়ারি হতে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক বইমেলা। বইমেলায় বহু বই প্রকাশিত হয়। নিম্নমানের প্রকাশকের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ভালো বই। তাই ভালো বই প্রকাশের দিকে সবাইকে মনোযোগ দিতে হবে। বছরে ভালো বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের যতœবান হতে হবে। একটি ভালো বই আজ ও আগামীর বন্ধু। প্রতি বছর বইমেলায় বহু বই প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু মানসম্পন্ন সামান্য আমাদের মনে রাখতে হবে ভালো শিক্ষা হচ্ছে ভালো জ্ঞান। ভালো জ্ঞান হচ্ছে ভালো নাগরিক। ভালো নাগরিক মানেই ভালো দেশ।

একটি সুস্থ জাতি গঠনে প্রয়োজন চিন্তা-চেতনার বৈপ্লবিক পরিবর্তন। নতুন চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধের মাধ্যমে নতুন মানুষ সৃষ্টি করা সম্ভব। মানবতার দক্ষ কারিগর দেশের সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী। তাই একটি ভালো বই পারে তাদের তৈরি করতে। এজন্য এর গুরুত্ব অনুধাবন করে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করা একান্ত জরুরি। একটি ভালো বই হচ্ছে আলোর কারখানা। বই পড়ে আগামী প্রজন্ম নির্দেশনা দেবে নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশকে। সুতরাং এর জন্য প্রয়োজন লেখক/প্রকাশককে সমৃদ্ধ ও সচেতনতার উদ্যোগ। মানসম্পন্ন বই প্রকাশ নিয়ে বেশির ভাগ প্রকাশনা সংস্থার নীতিমালা না থাকার দরুন আজ নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ দেশে আমাদের সদাশয় সরকারকে জরুরিভিত্তিতে বই প্রকাশের নীতিমালা জানানো উচিত বলে মনে করি। কেননা দেশের যত্রতত্র প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠায় যে যেভাবে পারছে মানহীন বই প্রকাশ করে দেশ ও জাতিকে ঠকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বই-পুস্তকের মান ঠিক না থাকায় কোমলমতি ছেলেমেয়েরা ভুলের ওপর ভিত্তি করেই চলে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জাতিকে সঠিক তথ্য দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। বই জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন করে। বিদ্যা শিক্ষা আমাদের জ্ঞানের ভা-ারকে প্রসারিত করে। কিন্তু সে বিদ্যা যদি সঠিকভাবে পথপ্রদর্শক না হয়, তাহলে বিদ্যা শিক্ষার মূল্য নেই। ভালো বই ও মানসম্মত বই আমাদের আলোয় আলোকিত করে। সুতরাং মানসম্মত বই প্রকাশের জন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close