সালাম সালেহ উদদীন

  ২৯ অক্টোবর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

অধঃপতিত সমাজ আদর্শহীন রাজনীতি

মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মাখলুকাত। বর্তমান সমাজের মানুষ মানবিকতা হারিয়ে যেভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে তাদের কী অভিধায় চিহ্নিত করা যেতে পারে। এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? এমন অপরাধপ্রবণ, অসহিষ্ণু, অধঃপতিত ও অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজ কী আমরা চেয়েছিলাম। এটা সত্য সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করছে। হেন কোনো অপরাধ নেইÑ যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে অবলীলায় হত্যা করছে। প্রেমের কারণে, অর্থ-সম্পত্তির লোভে সমাজে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে হতাশা নিঃসঙ্গতা বঞ্চনা অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা-মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যকে। অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে নিজের সন্তানকে হত্যা পর্যন্ত করছে। পারিবারিক বন্ধন স্নেহ ভালোবাসা মায়া মমতা আত্মার টান সবই যেন আজ স্বার্থ আর লোভের কাছে তুচ্ছ। সম্প্রতি ক্যাসিনো ব্যবসা সামনে চলে এসেছে ভয়ংকররূপেÑ যা সমাজের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এক শ্রেণির মানুষের কাছে কী পরিমাণ অবৈধ টাকা আছে ভাবতেও অবাক লাগে। অথচ ব্যাংকে টাকা নেই, মানুষ খাবার পায় না। কী বিচিত্র এই দেশ, কী বিচিত্র মানুষ।

আসলে আমরা আজ যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আমরা নানা রকম সামাজিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। পা পিছলে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। সমাজের একজন সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষ হিসেবে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কি সামাজিক ক্ষেত্রে, কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেÑ সর্বক্ষেত্রেই অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি- যা একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমরা স্বাধীন ও একটি গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনা করতে পারছি না। এ অবক্ষয় ইদানীং আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়; যা বর্তমান সমাজে প্রকট। সামাজিক নিরাপত্তা আজ ভূলুণ্ঠিত। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, দেশের সামগ্রিক যে অবক্ষয়ের চিত্র এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথই কী আমাদের খোলা নেই?

আমাদের অতীত বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, বর্তমান অনিশ্চিত এবং নিরাপত্তাহীনতার দোলাচলে দুলছে এবং ভবিষ্যৎ মনে হচ্ছে যেন পুরোপুরি অন্ধকার। যারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে পদে পদে কলুষিত করছে, সমাজকে ভারসাম্যহীন ও দূষিত করে তুলছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণœ করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। চারদিকে যে সামাজিক অবক্ষয় চলছে, চলছে তারুণ্যের অবক্ষয়Ñ এর কী কোনো প্রতিষেধক নেই? আমাদের তরুণরা আজ হতাশ এবং দিশাহারা। লেখাপড়া শিখেও তারা চাকরি পাচ্ছেন না। ফলে অনেকেই ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ খুন-ধর্ষণের মতো, ডাকাতির মতো অমানবিক এবং সমাজবিরোধী কাজেও জড়িয়ে পড়ছেন। কেউবা হয়ে পড়ছেন নানা ধরনের মাদক ও ক্যাসিনোতে আসক্ত। অনেকেই আবার সন্ত্রাসীদের গডফাদারদের লোভনীয় হাতছানিতে সাড়া দিয়ে সন্ত্রাসে লিপ্ত হচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? দায়ী আমরাই। আমরাই তাদের সুপথে পরিচালিত করতে পারছি না। এর পাশাপাশি ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দখল ও দলীয়করণের ব্যাপারটি তো দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে কে আমাদের পরিত্রাণ দেবে এবং কে-ইবা আমাদের পথ দেখাবে? নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সদস্যরা যদি নৈতিক গুণসম্পন্ন হয়, তা হলে সন্তানরাও নীতিবান হয়ে উঠবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সমাজের স্বাভাবিক ও সুস্থ গতিপ্রবাহ রক্ষা করার দায়িত্ব কার, রাষ্ট্র তথা সরকার, স্থানীয় সরকার, সমাজপতি নাকি সমাজের সচেতন মানুষের। সমাজ পুনর্নির্মাণের দায়িত্বই বা কার? আপতদৃষ্টিতে এসব প্রশ্ন সহজ মনে হলেও এর সমাধান বেশ জটিল। সমাজে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ বসবাস করে, বিচিত্র এদের মানসিকতা ও রুচি। এদের কোনো সমান্তরাল ছাউনির মধ্যে আনা কঠিন। তবে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা, সামাজিক অপরাধ কমিয়ে আনাসহ নানা পদক্ষেপ নিতে হবে সম্মিলিতভাবে। এটা একা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজ রক্ষা করা না গেলে পরিবার রক্ষা করা যাবে না, ব্যক্তিকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে, রাষ্ট্রও হয়ে পড়বে বিশৃঙ্খল।

বাংলাদেশে সমাজ পরিবর্তনের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা করা জরুরি। সমাজ পরিবর্তন মানে সামাজিক কাঠামো ও সমাজের মানুষের কার্যাবলি এবং আচরণের পরিবর্তন। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন। মনে রাখতে হবে বিশৃঙ্খল সমাজে বসবাস করে উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া যায় না। আমরা চাই, পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি, যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সামাজিক জীবন ব্যক্তির কাছে এক আশীর্বাদ, এর পূর্ণতা লাভ করে সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে। সমাজ ব্যবস্থা এমনই হওয়া উচিত, যাতে ব্যক্তির স্বপ্ন ভঙ্গ না হয়। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি। সমাজে অপরাধ এতটাই বেড়েছে যে একদিকে ব্যক্তির অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ অন্যদিকে সমাজও ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। এটা প্রতিরোধে প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা, প্রয়োজন তীব্র সামাজিক আন্দোলন। এই দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার ও সমাজকেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। সমাজের এক শ্রেণির বর্বর পাষন্ড মানুষের হাতে অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছে, অবলীলায় জীবন চলে যাচ্ছে। এমনকি শিশুর জীবনও চলে যাচ্ছে আপনজনের হাতে। এই ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতা রোধ করতে না পারলে একদিকে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে, অন্যদিকে পরিবারের সদস্যরাও থাকবে নিরাপত্তাহীন। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে। সুতরাং সময় থাকতেই সাবধান হওয়া সমীচীন।

কোনোভাবেই আমাদের সমাজ যেন আলোর দিকে অগ্রসর হতে পারছে না। কূপমন্ডূকতা লোভ অর্থ ও পেশি শক্তি ক্ষমতার দাপট আমাদের সমাজকে দিন দিন গ্রাস করছে। সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণেই মূলত এমনটি হচ্ছে। রাষ্ট্রের মধ্যে শৃঙ্খলা না থাকলে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে এটাই স্বাভাবিক, যার কারণে সামাজিক অবক্ষয় এত চরমে পৌঁছেছে। রাজনীতি তার আদর্শ হারিয়েছে অনেক আগেই। আদর্শ ও গণমুখী রাজনীতি দখল করে নিয়েছে দুর্বৃত্ত ও অপরাধী পরিবেষ্টিত রাজনীতি। ক্ষমতা ও পেশিশক্তির বলে রাজনীতিকরা হেন কোনো অপরাধ নেই করছেন না। সম্প্রতি যুবলীগের নেতাদের যে অপকীর্তি একে একে বেরিয়ে আসছে তা ভয়ংকর। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে যে যার মতো অপরাধ করেছে, অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা এমন হয়েছে একবার রাজনীতিতে নাম লেখাতে পারলেই কেল্লা ফতে। অর্থ-কড়ি, গাড়ি-বাড়ির অভাব নেই। আর এসবের জোরে তারা নানা ধরনের অপরাধ করছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে।

সমাজে এক শ্রেণির মানুষ ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে না, লেখাপড়া করাতে পারছে না সন্তানদের, আরেক শ্রেণির মানুষের টাকা রাখার জায়গা নেই। সমাজে ধনবৈষম্যের সৃষ্টি করছে এরাই, এরা গণশত্রু। সার্বিক পরিস্থিতি যদি এমন হয় তা হলে দেশ কীভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ‘চাটার’ দলের কথা বলেছিলেন, তারা এখন সংখ্যায় শতগুণ। এরাই অশুভ শক্তি এবং বাংলাদেশকে গ্রাস করছে, গ্রাস করছে দেশের অসহায় জনগণকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হয়েছেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ। তবে তাকে এই আন্দোলনে দমে বা থেমে গেলে চলবে না। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অপরাধীদের মূলোৎপাটন করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, নানা ছলে, প্রতারণায়, এমনকি প্রকাশ্যে সমাজের ভেতর ঢুকে পড়ছে দুর্বৃত্তরা। ঢুকে পড়েছে রাজনীতির ভেতর। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা করছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মানুষকে জিম্মি করে অর্থের পাহাড় করে তুলেছে। এরা দেশ ও সমাজের শত্রু। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের ভয়াবহ চিত্র উদ্বেগজনক। লোভী মানসিকতার কারণে এবং মানবিক মূল্যবোধ লোপ পাওয়াতে অন্যায়টাকেই তারা স্বাভাবিক মনে করছে। সামাজিক সুস্থতা আনয়নের পাশাপাশি নতুন সমাজ নির্মাণের জন্য এ ধরনের অবক্ষয় ও বৈষম্যকে প্রতিরোধ করতে হবে যে কোনো মূল্যে এবং এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close