এহসান বিন মুজাহির
আলোচনা
বিবাহ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
বিয়ে দুটি প্রাণের আপন হওয়ার এক বরকতময় অধ্যায়। দুটি অক্ষরের এ শব্দটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের জীবনের ইহ-পরকালীন কল্যাণ, অকল্যাণ, সফলতা-ব্যর্থতার অনেক হিসাব-নিকাশ। মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ হচ্ছে বিয়ে, যা প্রত্যেক মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা। বিয়ে মানুষের জীবনকে পরিশীলিত, মার্জিত এবং পবিত্র করে তোলে। আদর্শ পরিবার গঠন এবং মানব বংশবৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম হলো বিয়ে। বিয়ে এবং পারিবারিক জীবনকে ইসলামী শরিয়ত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। মানবজাতিকে লিভ-টুগেদারের মতো মহা-অভিশাপের হাত থেকে রক্ষা করতে বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্যই মহান রাব্বুল আলামিন বিয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে কালবিলম্ব না করে বিয়ে করা ইমানি দায়িত্ব। বিয়ে শুধু জৈবিক চাহিদাই নয়, বরং একটি মহান ইবাদতও বটে। ইসলামে বিয়ের গুরুত্ব ও উপকারিতা অনস্বীকার্য। বিয়ের মাধ্যমে রাসুল (সা.)-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতের ওপর আমল করা হয়। পূরণ হয় জৈবিক চাহিদা। ইমানের পরিপূর্ণতা অর্জন হয়। জেনা-ব্যভিচারের মতো বড় গোনাহ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। নৈতিক চরিত্রের উন্নতি ঘটে। বংশপরম্পরা অব্যাহত থাকে। সুখময় সমাজ ও আদর্শ পরিবার গঠন সম্ভব হয়। মানসিকভাবে দেহ ও মন সুস্থ থাকে। মনে প্রশান্তি আসে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর হয়। সর্বোপরি ইহ ও পরকালীন কল্যাণ লাভ হয়। সভ্যতার আগামী প্রজন্ম পবিত্র পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য বিবাহের বিকল্প নেই।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও কঠিন সত্য যে, বিবাহে যৌতুক, অতিরিক্ত দেনমোহর, গায়েহলুদ এবং জাঁকজমক আয়োজনের মাধ্যমে অনর্থক অপচয় করে বিবাহকে খুবই কঠিন করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয় ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন যে, বিয়ে যত সহজ এবং স্বল্পব্যয়ী হয়, ততই শান্তি ও বরকতময় হয় (মেশকাত : ১৯৫৮)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের সক্ষমতা রাখে তারা যেন বিয়ে করে ফেলে। কেনন এটা চোখের প্রশান্তি দানকারী ও লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী। আর যারা স্ত্রীদের ভরণ-পোষণের সামর্থ্য রাখে না, তারা যেন রোজা রাখে, কেননা এটা তাদের উত্তেজনাকে হ্রাস করবে (বুখারি : ৪৭৭৮)। মহান রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন (সুরা রুম : ২১)। আল্লাহ অন্যত্র এরশাদ করেনÑ তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের পোশাক এবং তোমরা (স্বামীরা) তাদের পোশাকস্বরূপ (সুরা বাকারা : ১৮৭)। আল্লাহ আরো বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়েহীন, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়; তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা বিয়ে করতে সামর্থ্য নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেন (সুরা নূর : ৩২-৩৩)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তার থেকে বানিয়েছেন তার সঙ্গিনীকে, যাতে সে তার নিকট প্রশান্তি লাভ করে (সুরা আরাফ : ১৮৯। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন কোনো ব্যক্তি বিবাহ করে, তখন সে যেন তার অর্ধেক ইমানকে পূর্ণ করে ফেলল। এখন বাকি অর্ধেকের ব্যাপারে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে (মেশকাত : ৩০৯৭)।
বর্তমান সমাজে বিয়ের দাওয়াত যেন গরিবের জন্য এক মহাবিপদ! বিয়ের দাওয়াত একটা আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু দাওয়াত পেয়ে এখন মানুষ খুশি হওয়ার চেয়ে উপহারের কথা চিন্তা করে হিসাব কষতে থাকে। অন্যদিকে যারা দাওয়াত দিয়েছেন তারাও অনুষ্ঠানে গিফট টেবিলের ব্যবস্থা করে থাকেন। কে কী দিলেন, তা খাতায় লিখে রাখা হয়। কেউ কেউ আছেন যারা এই উপহারের হিসাব লিপিবদ্ধ করা খাতাটি সযতেœ সংরক্ষণ করেন। কেউ দাওয়াত দিলে সেই পুরোনো খাতা বের করে দেখেন, তিনি তার দাওয়াতে কী দিয়েছিলেন। সেটা দেখে তার উপহার নির্ধারণ করা হয়! এ কেমন সম্পর্ক! এদিকে উপহার কেনার বিড়ম্বনায় অনেক গরিব মেহমান বিয়েতে অংশ নিতে পারেন না বা তাদের আর্থিক অবস্থা সবার সামনে প্রকাশ পাবেÑ এমনটি ভেবে কষ্ট করে হলেও উপহার জোগাড় করে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচতে হলে যেন এমনটি করতেই হয়। আসলে আমরা সামাজিক রীতিনীতিকে এতটাই কঠিন করে ফেলেছি যে, তা কখনো মানুষকে বাধ্য করছে! তাই কিছু মানুষ মন থেকে সেগুলো মেনে না নিলেও ‘সমাজে থাকতে হলে এসব করে থাকতে হবে’Ñ এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এমন মনমানসিকতা এবং চিন্তাকে বদলাতে হবে। আমি উপহার দেওয়া কিংবা নেওয়ার বিপক্ষে না; তবে প্রচলিত উপহার পদ্ধতির বিরোধিতা করছি। বর্তমান সমাজে বিয়েতে উপহারসামগ্রী প্রদান প্রথা দেখে মনে হয়, মেহমানরা বাধ্য হয়েই উপহার নিয়ে আসেন। এ যেন উপহারের বিনিময়ে খাদ্য! তাই বিয়েশাদিতে উপহারের এমন প্রথাকে পরিবর্তন করা একান্ত দরকার। আত্মীয়দের মধ্যে কে বড়লোক, কে গরিবÑ এসব বাছ-বিচার না করে এবং কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা না করে সন্তুষ্টচিত্তে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দাওয়াত খাওয়াতে হবে। কাজেই বিবাহে উপহারের প্রচলিত প্রথাকে পরিহার করা জরুরি।
বিবাহে সামর্থ্যানুযায়ী দেনমোহর ধার্য করা অপরিহার্য। মোহরানা হলো মুসলিম বৈধ বিবাহের সনদ। ইসলামী আইন অনুযায়ীও দেনমোহর হলো বিয়ের অন্যতম শর্ত। দেনমোহরের মাধ্যমেই দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার প্রথম বীজ বপন করা হয়। মোহরপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা স্ত্রীর মাঝে এই আত্মবিশ^াস ও আত্মপ্রশান্তি তৈরি করে। মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুসারে চাহিবা মাত্র স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। ইসলামী আইনে দেনমোহর স্ত্রীর বিশেষ অধিকার। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে নবী! আমি আপনার স্ত্রীগণকে আপনার জন্য বৈধ করেছি; যাদের তুমি মোহরানা প্রদান করেছে’ (সুরা নিসা : ৩৩)। হজরত আবু সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি হজরত আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করলাম, নবীজীর (সা.) বিয়েতে মোহরের পরিমাণ কত ছিল? তিনি বললেন, তার বিবাহের মোহর ছিল ‘বারো উকিয়া’ ও ‘এক নাশ্ব’ যার পরিমাণ ছিল ‘পাঁচশ দিরহাম’ (মুসলিম : ২৯৪৭)। হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা স্ত্রীদের মোহর বেশি ধার্য করবে না, কেননা তা যদি দুনিয়াতে সম্মানের এবং আখেরাতে আল্লাহর নিকট তাকওয়ার বিষয় হতো, তবে সেই ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে রাসুল (সা.) অধিক উপযোগী ছিলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) বারো উকিয়ার বেশি দিয়ে তার কোনো স্ত্রীকে বিবাহ করেছেন, তার কোনো কন্যাকে বিবাহ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই (তিরমিজি : ২৬৯১)। হজরত আমির বিন রাবিয়া (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন বনু ফাজারা সম্প্রদায়ের কোনো স্ত্রীলোককে এক জোড়া জুতার বিনিময়ে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি কি তোমার দেহ এবং সম্পদের পরিবর্তে এক জোড়া জুতা পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছ? স্ত্রীলোকটি বলল, হ্যাঁ। তারপর তাকে তিনি অনুমতি দিলেন (তিরমিজি : ১৯৭৪)। হজরত ওকবাহ বিন আমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বিবাহে যে শর্ত সর্বপ্রথম পূরণীয় তা হলো তা (মোহর), যা দ্বারা গুপ্তাঙ্গ বৈধ করা হয়েছে (বুখারি : ২৭৪১)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো নারীকে মোহরদানের শর্তে বিয়ে করেছে অথচ মোহর আদায়ের নিয়ত তার নাই; তবে সে ব্যভিচারী (তিরমিজি : ২৪৬১)। লোক দেখানো মাত্রা অতিরিক্ত মোহর ধার্য না করে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে; সে পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা এবং পরিপূর্ণ আদায় করা ইসলামের নির্দেশ। কোনো অবস্থায় মোহর খুব বেশি হওয়া উচিত নয়, যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আবার খুব কম হওয়াও উচিত নয়, যা স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"