রহিমা আক্তার মৌ

  ০২ আগস্ট, ২০১৯

সমাজচিত্র

মহিলা ও প্রতিবন্ধীর তুলনামূলক সম্পর্ক

ফার্মগেট থেকেই বাস ধরতে হবে আমায়। বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার আগেই দেখি ‘দোলনচাঁপা’ মহিলা বাস সার্ভিসের একটা বাস। দূর থেকেই হাত ওঠাই আর দ্রুত হাঁটতে থাকি। বাসের হেলপার খালা দেখেছে আমি দ্রুত হাঁটছি। অবশেষে বাসে উঠলাম।

অধিক জনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে নারীদের পাবলিক সার্ভিস বা গণপরিবহনে যাতায়াত করাটা বেশ কষ্টসাধ্য ও অনেকের কাছে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের কথা ভেবেই গত ২ জুন ২০১৮ মিরপুর ১২ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত শুধু নারীদের জন্য চালু হয়েছিল বাংলাদেশের বেসরকারি পরিবহন সংস্থার দোলনচাঁপার দুটি বাস সার্ভিস। ৩৬ আসনবিশিষ্ট বাংলাদেশের র‌্যাংগ্স গ্রুপ ও ভারতীয় ভলভো আইশার ভেহিকল লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে ‘দোলনচাঁপা’ এসি বাস নামানো হয় রাজধানীতে। ‘দোলনচাঁপা’ মহিলা বাসে সেদিন আমার তৃতীয় দিন ওঠা। উঠেই দেখি যাত্রী অল্প কয়েকজন। উঠেই গল্প শুরু করি সবার সঙ্গে। প্রথম দিন উঠেই তো আমি আনন্দে আত্মহারা হয়েছি। আজ উঠেই হেলপার খালার সঙ্গে কথা বলে যা জানলাম। আগে খালা একটা ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিংয়ের কাজ করতেন। এই বাসের জন্য লোক নিয়োগ হবে জেনে খালা আবেদন করেন। নিয়োগ পান, নিয়োগ দেওয়ার সময় বলা হয়েছে, ‘আগে দুদিন করে দেখো পার কি না। না পারলে করবে না।’ খালা বেশ পেরেছেন। তাই কাজ করছেন। জেনে ভালোই লাগল, নতুন পেশায় আমাদের নারীরা।

কথা হয় অন্য যাত্রী আপাদের সঙ্গে। মহিলাদের চলার পথ অনিরাপদ, এ নিয়ে কয়েকটা লেখা আমি আগেও লিখেছি। তবু নতুন করে বলার অনেক কিছু আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনই বাসে সিট পাওয়ার কথা লিখি না। কারণ বাসে বসার জন্য আমি সিট চাই না, চাই বাসে বা সব ধরনের গণপরিবহনে নিরাপত্তা। চাই একটু নিরাপদভাবে দাঁড়াতে বা যাতায়াত করতে। সিট খালি থাকলে বসব, নইলে দাঁড়িয়ে যাব। একটা সময় পুরো বাসে দু-তিনজন মহিলা যাত্রী দেখা যেত। এখন প্রতিটি বাসে ১০-১২-১৫ জন কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি মহিলা যাত্রী উঠতে দেখা যায়। এর কারণ আমাদের নারীরা বাইরে কাজ করছেন। নিজের যোগ্যতায় কাজ পাচ্ছেন, নিজের যোগ্যতা প্রকাশ করার সময় এখন এসেছে, তাই নারীরা ঘর বাহির সব সামলাতে পারছেন। সামলাচ্ছেনও। আমার পাশে বসা ৫৫-৬০ বছর বয়সি এক খালাম্মা। মহিলা বাস আর বাসে যাতায়াত নিয়ে লিখব বলতেই খালাম্মা বলেন, আমার দুইটা কথা লিখবেন মনে করে। প্রতিটা বাসে লেখা ‘নারী শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্যে’ মাথার ওপরে লেখা আর লেখার নিচে বসে আছে পুরুষরা। মহিলারা দাঁড়ানো দেখে ওঠে তো না, উঠতে বললে বলে, ‘ওই যে বাসের মাঝখানে যে মহিলারা তাদের উঠতে বলেন’। আচ্ছা বাসের সামনের সিট নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য তাই বলে কি অন্য সিটে মহিলারা বসতে পারবেন না। ‘ইচ্ছা করে সব বাস থেকে এই স্টিকারটা তুলে ফেলি। নারীদের প্রতিবন্ধীভাবে এই সমাজ। আচ্ছা মা, বলবে কী নারী আর প্রতিবন্ধী এদের সম্পর্কটা ঠিক কী?’

গণপরিবহনে আমার চলাচল প্রতিদিনের নয়, তবু প্রায় উঠি। পারতপক্ষে আমি দোতলা বাসে উঠি। তার কারণ দোতলা বাসের দরজা দুটো। অধিকাংশ হেলপাররা পুরুষ যাত্রীকে পেছনের গেট দিয়ে ওঠতে বলেন। আর সামনের গেট দিয়ে মহিলারা। এতে করে ওঠতে-নামতে সমস্যা কম হয়। আর বাসে সিট না পেলেও সামনের দিকে দাঁড়াতে পারি। আমরা মহিলারা দাঁড়ালে ভিড় হলেও সমস্যা হয় না (শুধু পকেট সাবধান রাখতে হয়)। কিছু কিছু হেলপার সামনে দিয়ে পুরুষ যাত্রী ওঠালেই আমি নিজেও বলি, ‘মামা পুরুষদের পেছনের গেট দিয়ে ওঠান।’ অনেকেই শুনেন, কিছু হেলপার পাত্তা দেয় না। আবার কিছু যাত্রীকে বললেও তারা সামনের গেট দিয়েই ওঠেন। এটা ঠিক যে, একটা সময় গণপরিবহনে মহিলা সিট নিয়ে অনেক কথা হয়। যার কারণে বাসের সামনের দিকের ৯টা সিট নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ করে স্টিকার লাগানো হয়েছে। কিন্তু প্রায় নিজের মনে প্রশ্নÑ ‘মহিলা ও প্রতিবন্ধী সম্পর্কটা আসলে কী?’ প্রতিবন্ধী বলতে-চলতে-ফিরতে অক্ষম বা শারীরিকভাবে শরীরের যেকোনো অঙ্গে অস্বাভাবিক অবস্থা। প্রতিবন্ধী তো পুরুষও হতে পারে। আর নারী হলো সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী, জানি যত পুরুষ গণপরিবহনে চড়েন তত মহিলা চড়েন না। এখানে সংখ্যা কোনো বিষয় না, বিষয়টা হলো নিরাপত্তার।

ব্যক্তিগতভাবে অনেক বয়স্ক ব্যক্তির জন্য আমি বাসের সিট ছেড়ে দিয়েছি। ব্যক্তিটি মহিলা, না পুরুষ তা বিবেচনা করিনি, বিবেচনা করেছি তার বয়স ও শারীরিক অবস্থাকে। শুধু আমি নই, অনেক মহিলাকেই দেখেছি বয়স্কদের জন্য সিট ছেড়ে দিতে। বাসে মহিলা সিট নয়, চাই নিরাপত্তা। প্রতিবন্ধীদের জন্য সিট বরাদ্দ করতেই হবে; সে দুজন হোক আর চারজন হোক। তবে এটাও ঠিক যে, প্রতিবন্ধী যদি মহিলা হন, তা হলে তার সিটের পাশাপাশি নিরাপত্তারও প্রয়োজন আছে। মনুষ্যত্বহীন পুরুষদের কাছে নারী নারীই, সে সুস্থ হোক, স্বাভাবিক হোক আর প্রতিবন্ধী হোক। সুযোগ পেলেই তারা...।

নির্ধারিত মহিলা সিটে পুরুষ বসা যাবে নাÑ এটা কোনো কালেই কেউ বলে না। সিট খালি থাকবে আর পুরুষ যাত্রী দাঁড়িয়ে যাবেÑ এটা হয় না। সিট যখন খালি উনারা বসতেই পারেন। কথা হলো, মহিলা যাত্রী উঠলে সেই সিটগুলো খালি করে দিলেই হয়। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয় তখনিই যখন খালি সিট পেয়ে বসে পরে আর ওঠে না। যদি নাই উঠবে তা হলে বাসের গায়ে স্টিকার কেন? স্টিকার থাকলে ছাড়তে বাধ্য করতে হবে।

দোলনচাঁপা বাস চালু হওয়ার পরপরই এ নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। বাস পাওয়া যায় না, বাস রাস্তায় দেখা যায় না। মহিলা বাস সার্ভিসের পক্ষে আমিও। কিন্তু ওই যে প্রতিটা বাসে এখনো তুলনামূলকভাবে মহিলা যাত্রী, পুরুষ যাত্রীর চেয়ে কম। এর ফলে মহিলা বাসগুলোতে অধিকাংশ সময় সিট খালি থাকে। এর কারণ মহিলা বাস আছে, এটা অনেকেই জানেন না। আর দু-তিনজন মহিলার সঙ্গে একজন পুরুষ থাকলেই সেই মহিলারা এসব বাসে উঠতে পারেন না। দোলনচাঁপা বাস ৩৬ সিটের। এই ৩৬ সিট ভরে যায় সকালে অফিস শুরুর সময়ে আর বিকালে ছুটির সময়ে। মহিলা বাসের অধিকাংশ যাত্রীর একই কথা, মহিলা বাস এত বড় প্রয়োজন নেই। ১৫-১৬ সিটের মিনিবাস বা লেগুনা সাইজের পরিবহন নামাতে হবে। এবং ১০-১৫টি বাস নয়, প্রতিটি রুটে একসঙ্গে অনেকগুলো করে পরিবহন নামাতে হবে।

আরেকটা বিষয় প্রায়ই চোখে পড়ে, লেগুনা বা টেম্পোতে ওঠার সময় মহিলারা ওঠার সুযোগই পান না। সেদিন ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে থেকে নিউমার্কেট যাওয়ার জন্য টেম্পো স্টেশনে অপেক্ষা করি। টেম্পো এলেই পুরুষরা দৌড়ে গিয়ে টেম্পো ধরেন। টেম্পোর পেছন পেছন ছুটে যায়। কিন্তু মহিলারা তা পারেন না। কোনো নিয়ম তো নাই, এসব ক্ষেত্রে ড্রাইভাররাই নিয়ম করলে পারে যে টেম্পোর এক পাশে পুরুষ, অন্যপাশে মহিলারা বসবেন। মহিলা কম হলে পুরুষ বসতেই পারেন। যেখানে ১৫ টাকা টেম্পো ভাড়া দিয়ে নিউমার্কেট যাওয়া যায়; সেখানে ৬০-৭০ টাকা রিকশা বা ১২০-১৫০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে যাওয়া শুধু অতিরিক্ত খরচই নয়। অনেক বেশি আর্থিক জুলুমও বটে।

প্রায় সময় বাসে মহিলারা উঠতে চাইলেই হেলপার বলে, যাওয়া যাবে না, সিট নেই। তা হলে মহিলারা যাবেন কী করে? আমি বাসে থাকলেই হেলপারকে বলি, মামা যাওয়া যাবে না, এটা বলিও না। বরং বল সিট খালি নেই দাঁড়িয়ে যেতে হবে। এতে করে যে দাঁড়িয়ে যেতে চাইবে সে উঠবে। আসল কথা হলো মহিলা বা পুরুষ নয়, গণপরিবহন জনগণের, মহিলা হোক আর পুরুষ হোক। মহিলাদের প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে তুলনা করে স্বাভাবিক মহিলাদেরও প্রতিবন্ধী বানাতে চায় এই মেরুদন্ডহীন সমাজটা। মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ বলেই মহিলাদের প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে সম্পর্ক মিলিয়ে দেয়। নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিই ‘মহিলা ও প্রতিবন্ধী সম্পর্কটা কি?’ বাঙালি প্রকাশনার কর্ণধার আরিফ নজরুল বলেন, ‘মহিলাদের নির্ধারিত সিটে যে পুরুষ বসে, তারাই প্রতিবন্ধি’। ছড়াকার নাফে নজরুল বলেন, ‘জগতের কাছে কঠিন প্রশ্ন’। সত্যিই কঠিন প্রশ্ন, এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আমাদের মনে, কিন্তু জবাব দেওয়ার কেউ নেই। তবে এটাও ঠিক জবাব বের করতেই হবে, প্রতিবাদ করতেই হবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য যতটা প্রয়োজন সিট চাই। গণপরিবহনে লোক দেখানো স্টিকার নয়, সিট পাই বা না পাই মর্যাদা চাই।

লেখক : সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close