শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম
দুই ছাত্র ‘খুনে’ জঙ্গি তামিম?
চট্টগ্রামে গত ১৩ এপ্রিল জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার মহিউদ্দিন তামিম ‘জোড়া খুন’ মামলার প্রধান আসামি ছিলেন। পরিকল্পিতভাবে ‘গাড়ি দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে’ দুই ছাত্রকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় ২০১২ সালে তামিমসহ আটজনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আদালতে মামলা দায়ের হয়েছিল। পরবর্তীতে খুনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে মামলায় জঙ্গি তামিমসহ আসামিদের অব্যাহতি চায় পুলিশ। তবে সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি এখনো।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ১ মার্চ দুপুরে কাজীর দেউড়িতে মহসিন কলেজের বিএসসি (পাস) কোর্সের ছাত্র মিনহাজ উদ্দিন তানভীরের সঙ্গে দেখা হয় তামিমের। তখন পতেঙ্গায় বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে মিনহাজকে মাইক্রোবাসে উঠতে বলেন তামিম। পতেঙ্গায় যাওয়ার বিষয়টি মিনহাজ মুঠোফোনে তার বড় বোন তামিয়াকে জানালে তিনি আপত্তি জানান। তখন জোর করে মিনহাজকে গাড়িতে তোলা হয়। আগে থেকে গাড়িতে ছিল প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সৌমিক বড়–য়া অথৈ, মিজানুর রহমান ইভলু, পলাশ, আকবর, তাফিম এবং ঢাকার নটর ডেম কলেজের ছাত্র মাসাত ও ইমাম। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তামিম। পরে পতেঙ্গার টোল রোড়ের লতিফপুর এলাকায় গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ঘটনায় মিনহাজ উদ্দিন তানভীর ও সৌমিক বড়–য়া অথৈ নিহত হন।
তবে পরিকল্পিতভাবে খুন করে গাড়ি দুর্ঘটনার নাটক সাজানো হয়েছে অভিযোগ করে ২০১২ সালের ২২ মে আদালতে তামিম ও তার ভাই তাফিমসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহত মিনহাজের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ ছালেহ। মামলাটি তৎকালীন কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সদীপ কুমার দাশ তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে একই বছরের ২১ জুলাই আসামিরা নির্দোষ ও ঘটনাটিকে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ উল্লেখ করে তিনি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। পরে বাদীপক্ষের নারাজির প্রেক্ষিতে অভিযোগটি গোয়েন্দা পুলিশকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন আদালত। গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আতিক আহমেদ চৌধুরী ২০১৩ সালের ৬ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে আসামিদের কোনো অপরাধ পাওয়া যায়নি বলে আদালতকে জানান। এরপর বাদীপক্ষ থেকে ফের নারাজি দেওয়া হলে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত সেটি খারিজ করে দেন। নিম্ন আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জজ কোর্টে রিভিশন মামলা করেন বাদী মোহাম্মদ ছালেহ। মামলাটি প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আছে, এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
মামলার বাদী মোহাম্মদ ছালেহ বলেন, আমার চাচাতো ভাই মিনহাজের শরীরে রড দিয়ে মারলে যে রকম আঘাত হয় সেরকম আঘাত ছিল। মারা যাওয়া সৌমিক বড়–য়ার শরীরে গর্তের মতো হয়েছিল, গুলি করলে যেরকম হয়, তেমনই। বলা হচ্ছে, গাড়িটি চালাচ্ছিল তামিম, ওই গাড়িতে তার ভাই তাফিমও ছিল। অথচ তাদের কিছুই হয়নি।
তিনি বলেন, ঘটনার পর আমাদের সুস্পষ্ট তথ্য দেয়নি তামিমের বাবা ও মা। আমাদের না জানিয়ে চমেক হাসপাতাল থেকে সন্ধ্যা ৬টায় বেসরকারি মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে মিনহাজকে নিয়ে যায় তারা। সেখানে নিয়ে চিকিৎসা না দিয়ে ফেলে রাখা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে রাত দেড়টায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে মাথাসহ শরীর কাটাছেঁড়া করা হয়। এরপর রাত ৩টার দিকে মিনহাজ মারা গেছে বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। সবমিলিয়ে এটা স্পষ্ট, তামিমসহ অন্য আসামিরা পরিকল্পিতভাবে আমার ভাই মিনহাজ ও সৌমিককে মেরে দুর্ঘটনা সাজিয়েছে।
এদিকে, গত ১৩ এপ্রিল রাতে নগরীর কোতোয়ালি থানার আনন্দবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে মহিউদ্দিন তামিম, আফজার হোসেন, মুনতাসিরুল মেহের, মো. ইমরান খান, মো. দাউদ নবী পলাশ, চৌধুরী মোহাম্মদ রিদওয়ান ও এস এম জাওয়াদ জাফর নামে সাত যুবককে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার করে র্যাব। এদের মধ্যে দাউদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়, অন্যদের বাড়ি চট্টগ্রামে। সবাই উচ্চ শিক্ষিত।
র্যাব বলছে, ২০১৩ সালে আসকার দিঘীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত আতরজান জামে মসজিদে ইবনে মোস্তাকের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তারা মোস্তাকের মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতায় উৎসাহী হয়ে উঠে। তারা কথিত জিহাদের মাধ্যমে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ ও দেশের সমমনা জঙ্গিদের একত্রিত করার কাজে যুক্ত ছিল।
মিনহাজ ও সৌমিক হত্যা মামলার বাদী মোহাম্মদ ছালেহ বলেন, কি কারণে তাদেরকে তামিমরা খুন করেছিল তখন সেটা বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি, আমার ভাইকে তামিম জঙ্গিবাদে জড়াতে চেয়েছিল। সে রাজি না হওয়ায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনার সাক্ষী হওয়ায় হয়তো সৌমিককেও তারা মেরে ফেলেছে। সেদিন গাড়িতে থাকা ইভলুও আমাদের কাছে মুখ খুলেনি। গাড়িতে থাকা অন্যদের আমরা চিনি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া সাত যুবকের মধ্যে দুইজন আইএসের মতাদর্শ সমর্থন করেন এবং দুইজন আল কায়েদার মতাদর্শ সমর্থন করেন। আইএস ও আল কায়েদার মতাদর্শে ভিন্নতা থাকার পরও চট্টগ্রামে কিভাবে তারা একত্রিত হয়েছে তা নিয়ে ভাবছেন তারা। এ বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত শুরু হয়েছে বলেও জানিয়েছেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
এদিকে, র্যাব-৭ চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মিমতানুর রহমান বলেন, হোয়াটস অ্যাপে দ্বীন ফোর্স এক্সট্রিম ও ইখোয়ান নামের দুটি গ্রুপে সক্রিয় ছিল গ্রেফতার সাত জঙ্গি। তারা নিজেদেরকে কথিত জিহাদের জন্য প্রস্তুত করছিল। এ ছাড়াও তারা জঙ্গি সংগঠন আইএসকে অনুসরণের চেষ্টা করে। তাদের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক উগ্রবাদী বই পেয়েছি আমরা। গ্রেফতার জঙ্গিদের মধ্যে নেতা ছিলেন তামিম।
পিডিএসও/মুস্তাফিজ
"