মুহিব্বুল্লাহ কাফি

  ২৩ মার্চ, ২০২৪

আমরা হইনি স্বাধীন

অনুষ্ঠান হচ্ছে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে। স্কুলমাঠে। প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। হয়েছে স্টেজ সাজানো। প্যান্ডেল ভর্তি মানুষ। এই দিক দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল টিয়া পাখির ছা-টা। এমন দৃশ্য থমকে দিল তাকে। টিয়া পাখির ছা স্কুল কোণঘেঁষা লম্বা তালগাছের মগডালে গিয়ে বসেছে। আগ্রহভরে সব দেখছে ও। তার উৎসুক নয়ন দেখেনি এর আগে এমন দৃশ্য।

সেমিনার শুরু হলো। শুরু হলো স্বাধীনতার গান। একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় গল্প। মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প। পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিকতার গল্প। কালো ভয়াল দিনরাতে সেই নরপশুদের নির্যাতনের গল্প।

টিয়া পাখির ছা তালগাছের মগডালে বসে শুনছে স্বাধীনতার গান। শুনছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা। শুনছে আমাদের দেশের মা-বোনদের লুণ্ঠিত ইজ্জতের গল্প। পাকিস্তানি বাহিনীদের পাশবিকতার কথা। তাদের মাত্রাহীন অত্যাচার ও অন্যায়ের কথা।

টিয়া পাখির ছা এবার খুব রাগ নিল। তার কোমল মনে। মায়ের প্রতি। আমাদের দেশের এমন একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্প আছে, যা কোনো রূপকথা না। অথচ মা আমাকে বলল না! মায়ের কী জ্ঞান বলতে কিছু নেই। সে খুব আশ্চর্যান্বিত হলো।

টিয়া পাখির ছা সকাল থেকে তালগাছের ওই মগডালে বসেছিল। এক ধ্যানে ও সব শুনছিল। সূর্যি মামার আলোও কমে এলো। তালগাছের কয়েকটা পাতা দুলিয়ে দিয়ে গেল মধ্যাহ্নের শেষ বাতাস। বিকেল তার আভা ছড়াতে লাগল। প্যান্ডেলের আশপাশ জুড়ে। শেষ হলো অনুষ্ঠান। সহসাই টিয়া পাখির ছায়ের মনে পড়ল বাসার কথা। না, এবার বাসায় ফিরতে হবে। ফুড়ুত করে উড়ে তার মায়ের কাছে এলো টিয়া পাখির ছা। মা টিয়া পাখি তার ছাকে দেখে হাউমাউ করে উঠল। বলল, কোথায় ছিলে সারা দিন। কত জায়গায়তেই না খোঁজেছি তোমাকে।

টিয়া পাখির ছা বলল, মা মা, মা। ওই স্কুলমাঠে আমাদের দেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমি ওখানেই ছিলাম।

জানো মা, এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর অনেক অত্যাচার করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীরা। এ দেশের মা-বোনদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিল। ওই নরপশুরা। পাকিস্তানিরা তাদের উর্দু ভাষা এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। জোরপূর্বক। এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। অন্যায়ভাবে।

টিয়া পাখির ছা একটু থেমে ফের বলতে লাগল, মা জানো, এরপর কী হয়েছিল?

এরপর এ দেশের দামাল ছেলেরা অস্ত্র হাতে তুলে নিল এবং শুরু করল যুদ্ধ। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে।

এরই মধ্যে ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিলেন ভাষণ। রেসকোর্সের ময়দানে। ‘তোমাদের কাছে যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ করো। বিজয়ী আমরা হবই ইনশাআল্লাহ’।

এভাবে মুক্তিবাহিনীরা দীর্ঘ ন-মাস যুদ্ধ করেন এবং এ দেশ স্বাধীন করেন। আর এদিনই তথা- ২৬ মার্চ এ দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। যেন সব আবেগ ঢেলে দিয়ে বলল টিয়া পাখির ছা।

টিয়া পাখির ছা দেখল তার মা পাখির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে বলল, মা, তুমি কি দীর্ঘ ন-মাস যুদ্ধের কথা মনে করে কাঁদছো?

মা পাখি বলল, নারে বাবা। আমি সে কারণে কাঁদছি না। তবে, এটা সত্য পাকিস্তানি হানাদাররা অনেক অন্যায়-অত্যাচার করেছিল এ দেশের নিরীহ মানুষদের ওপর। শেষে এ দেশের দামাল ছেলেরা যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছে এ দেশ। কিন্তু আমার কষ্টটা অন্য কারণে। বলল মা টিয়া পাখি।

তোমার এত কষ্ট কোন কারণে মা। টিয়া পাখির ছা মা পাখির দুগাল ধরে জানতে চাইল।

মা পাখি বলল, এ তুমি বুঝবে না বাবা।

আমি বুঝব মা। তুমি বলো। পিড়াপিড়ি শুরু করল ছা-টা।

টিয়া পাখির ছার কথা ফেলতে না পেরে মা পাখি বলতে লাগল।

এ দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। স্বাধীন হইনি আমরা। পশুপাখির জাত।

টিয়া পাখির ছা বলল, কেন মা, আমরা কী স্বাধীন না? আমরা তো এই স্বাধীন দেশেই থাকি। এ দেশের মানুষ স্বাধীন হলে তো আমরাও স্বাধীন।

মা পাখি বলল, না বাবা, এ দেশের মানুষ স্বাধীন হলেও স্বাধীন হইনি আমরা। তুমি জানো তোমার বাবা হারিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি হারাননি।

টিয়া পাখির ছার চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। তার মায়ের কথা শোনে। কারণ, মা পাখি তাকে সব সময় বলে এসেছে, তার বাবা হারিয়ে গেছে। কিন্তু আজকে মা পাখি বলল তিনি হারাননি!

তাহলে কোথায় আমার বাবা? বলো মা, বলো? টিয়া পাখির ছা উৎকর্ণ হয়ে উঠল। তার চোখে-মুখে বাবাকে দেখার ঢেউ খেলে উঠল। বাবাকে না দেখার আকুতি জেগে উঠল। বাবাকে দেখার উৎসুক নয়ন উপচে পড়ল মায়ের মুখের কথার ওপর।

মা পাখি বলতে লাগল, তোমার বাবাকে শিকারিরা শিকার করে নিয়ে গেছে এবং বিক্রি করে দিয়েছে বাজারে। কিনেছে ওই মসজিদের তিনটা বাড়ির পরের বাড়ির খোকন নামে এক ছেলে।

আবারও মা পাখির চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। টিয়া পাখির ছা তা দেখে তার মায়ের চোখ দুটো মুছে দিল তার ছোট ছোট পাখার পালক দিয়ে এবং বলল, মা, বাবা কি এখনো বেঁচে আছেন?

মা পাখি বলল, হ্যাঁ, বাবা। এখনো তোমার বাবা ওই ছোট্ট খাঁচায় বন্ধি। এমনকি তোমার বাবাকে তারা তাদের ভাষা শিখিয়ে দিয়েছে। জোর করে। যেমনটা করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর।

আচ্ছা মা, পাকিস্তানি বাহিনী তো এ দেশের মানুষদের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। চেয়েছিল জোর করে চাপিয়ে দিতে তাদের ভাষা। তেমন করে কি আমার বাবাকেও...? টিয়া পাখির ছা তার কথা শেষ করতে পারছে না। তার বুকফাটা কান্না আসছে।

মা পাখি বলল, হ্যাঁ, বাবা। ঠিক তেমনিই।

আবার টিয়া পাখির ছা বলল, তাহলে মা আমরা এ স্বাধীন দেশে থেকেও স্বাধীন না? বাচ্ছা পাখিটার কথা শুনে আবারও হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন মা টিয়া।

এবার টিয়া পাখির ছাও মা পাখির মতো কাঁদতে লাগল এবং বলতে লাগল, তাহলে কি এই স্বাধীন দেশে আমরা স্বাধীন নই? আমার বাবা কি স্বাধীন মানুষের কাছে থাকবে পরাধীন হয়ে?

মা পাখি এর কোনো জবাব করতে পারল না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close