ফারুক হোসেন সজীব

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩

মানবতার জয়

সৎপথ মানুষকে মুক্তি দেয় তাই না আম্মু? প্রশ্নটি করেই নিপা কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আম্মুও কথাটি শুনে রীতিমতো অবাক হন! ভাবেন, এতটুকু মেয়ে কীভাবে বলল এ কথাটি! নাকি কারো কাছ থেকে শুনে বলেছে! হবে হয়তো আজকাল নিপা দাদুর কাছে বেশ ঘোরাঘুরি করছে। সেখান থেকেই নিপা এমন কথা শুনেছে!

কিন্তু একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়, নিপা ইদানীং অহেতুক খেলাধুলা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। আগে পুতুল খেলা ভীষণ পছন্দ করত। পুতুলকে জামা পরানো, পুতুলের বিয়ে দেওয়া। এ ধরনের খেলায় সে মেতে থাকত। কিন্তু ইদানীং মানুষের জীবনবোধ নিয়ে বেশ কৌতূলহী হয়ে উঠেছে নিপা! এই তো গতকালই আম্মু দেখলেন, নিপা একটি অসহায় মেয়েকে তার টিফিনের টাকাটা দিয়ে দিল।

আম্মু অবাক হয়ে বলেছিলেন, সেকি নিপা! তুমি তোমার টাকাটা ওই ভিখারি মেয়েটিকে দিয়ে দিলে? নিপা কেমন রেগে গিয়ে আম্মুকে বলল, তুমি ওই মেয়েটিকে কেন ভিখারি বললে? ও গরিব বলে তাই? ও তো মানুষ! আর আমরা মানুষ হয়ে কেন তবে মানুষকে অবহেলা করছি! বলতে পারো আম্মু?

আম্মু নিপার মুখ থেকে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে মামুণি! নিপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে তাহলে কথা দাও আর কক্ষণো এমনটি বলবে না!

ঠিক আছে কথা দিলাম!

তাহলে ওই মেয়েটিকে সরি বলে দাও! আম্মু মিষ্টি হেসে বললেন, ঠিক আছে মামণি। চলো মেয়েটিকে সরি বলে আসি! নিপা আম্মুর হাত ধরে মেয়েটির কাছে নিয়ে গেল। মেয়েটি একটু ভয় পেল তাদের দেখে। হয়তো ভেবেছে, নিশ্চয় টাকা ফেরত নিতে এসেছেন তারা!

কিন্তু একি! মহিলাটি যে মিষ্টি-মিষ্টি হাসছেন। আম্মু মেয়েটিকে বললেন, আমায় ক্ষমা করো মা! আমি ওভাবে বলাতে তুমি বুঝি অনেক কষ্ট পেয়েছো, তাই না?

মেয়েটি নিপার আম্মুর কথা শুনে অবাক হয়ে ভীষণ লজ্জা পেল! নিপা দেখল, মেয়েটি এখন কী সুন্দর করেই না হাসছে! অথচ কিছুক্ষণ আগেও মুখ ভার করে ছিল! সেদিন নিপাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে সারা রাস্তা আম্মু নিপাকে নিয়ে ভেবেছেন। ভেবে ভীষণ খুশিও হয়েছেন! কারণ নিপা অন্য মেয়েদের মতো হয়নি!

আর তা ছাড়া সে এখন নিজের চাহিদাগুলোও কেমন অদ্ভুতভাবে কমিয়ে ফেলেছে। এখন সে নিজের জন্য কোনো কিছুই কিনতে চায় না! আগে নতুন জামা-কাপড় দেখলেই বায়না ধরত কেনার জন্য। দরকার হলে কেঁদে বুক ভাসাত। না খেয়েও থাকত। কিন্তু এখন বলে কি না তার এসবের কোনো দরকার নেই? আম্মু তো অবাক হয়েই নিপাকে বলেছিলেন, কেন মামণি! তোমার পোশাক তো খুবই পুরোনো। আর নোংরা হয়ে গেছে। মানুষ এমন পোশাকে তোমাকে খারাপ বলবে! নিপা মুখ ভার করে বলেছিল, আম্মু নতুন ড্রেস দেখলে স্কুলের বন্ধুরা আমার সঙ্গে মিশতে চায় না! ভাবে, আমরা হয়তো অনেক বড়লোক! এমন ভাবলে, আমারও ভীষণ কষ্ট হয়। আমরা তো একসঙ্গেই পড়ি। তাহলে কেন ওরা এমন করে ভাববে? আর ওদের পুরাতন পোশাক দেখে আমারও নতুন পোশাক একদমই পরতে ইচ্ছে করে না! নতুন পোশাক পরলে আমার কী মনে হয় জানো? মনে হয়, আমি আমার বন্ধুদের ছোট করছি। ওরা যে আমার বন্ধু! প্রকৃত বন্ধু কি তার বন্ধুকে ছোট করতে পারে? তুমিই বলো!

তাই আমি তা করতে পারব না! আর তা ছাড়া আমার ড্রেস তো এখনো নতুনই আছে! আম্মু নিপার কথা শুনে আর তেমন কিছু বললেন না! তবে, নিপার এমন কথায় আম্মু ভীষণ খুশি হলো! কারণ, বর্তমান যুগ এখন এমন হয়েছে যে, মানুষ-মানুষকে ছোট করতে পারলেই যেন অনেক বড় হয়ে যায়! মানুষ কেমন স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে! শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকছে সবাই! তারপর থেকে নিপার এমন পরিবর্তনে আম্মু তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন। আম্মু এখন নিপাকে বোঝারও চেষ্টা করছেন। নিপা কী করলে হাসিখুশি থাকে। আম্মু এখন সে কাজগুলোই করে যাচ্ছেন! নিপা দুদিন পর পর বাসায় ওর দু-একজন বান্ধবীদেরও নিয়ে আসছে! নিপা ওদের না খাইয়ে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না! নিপার সঙ্গে ওদের খেতে দেখে আম্মুরও ভীষণ ভালো লাগে! কোনো সমস্যা হলে আম্মু ওদের পাশে দাঁড়ান। কারণ আম্মু বুঝে গেছেন, ওরা ভালো থাকলে। নিপাও ভালো থাকবে।

নিপা হঠাৎ বলল, কী হলো আম্মু কিছু বললে না? সৎপথ মানুষকে মুক্তি দেয় তাই না?

অবশ্যই মামণি! তুমি সত্য কথা বললে। সৎপথে থাকলে তোমার অন্তর তোমাকে মুক্তি দেবে। তখন তুমি হবে মুক্ত পাখির মতো স্বাধীন। নিপা হঠাৎ আম্মুকে প্রশ্ন করে, মানুষ কখন স্বাধীন হয় জানো?

কখন স্বাধীন হয়? আম্মু জিজ্ঞেস করলেন। নিষ্পাপ হলে!

নিষ্পাপ হলে? কী বলছো তুমি? হ্যাঁ ঠিক বলছি! আর মানুষ নিষ্পাপ হতে পারে শুধু মানবতার জয়গানেই!

আম্মু অবাক হয়ে বললেন, আচ্ছা তুমি একটি কথা বলো তো, তুমি এমন কথা কোথায় পাও? মানে কে তোমাকে এগুলো বলে দেয়। নিপা অবাক হয়ে বলল, দাদুর কাছ থেকে শুনি! তোমার কাছ থেকেও শুনি। স্কুলের টিচারদের কাছ থেকেও শুনি! আর আমি তো তোমাদের সবার কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করি! আম্মু অবাক হয়ে বললেন, কী আশ্চর্য!

আম্মু মনে-মনে ভাবলেন, এটার মানে তো এই যে, আমরা যা বলি তা নিজেরাই মেনে চলি না! শুধু উপদেশ দিয়ে যাই। আর এতটুকু মেয়ে সে কি না আমাদের কথাগুলো মেনে চলছে!

আম্মু খুশিতে নিপাকে বুকে টেনে নিয়ে এগালে-ওগালে চুমু খেলেন! সেই সঙ্গে মনে-মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিপার জন্য দোয়া করলেন। কারণ আম্মু বুঝতে পেরেছেন, নিপা এক দিন অনেক বড় হবে! আর এদের মাধ্যমেই তো মানবতার জয় হবে!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close