জামসেদুর রহমান সজীব

  ১১ মে, ২০১৯

আঁকা স্বপ্ন হবে সত্যি

ধবধবে সাদা আকাশ। কয়েকটা জায়গায় নীলাভ রেখা এমনভাবে লেপ্টে আছে, দেখে মনে হবে কেউ খুব যতœ নিয়ে এঁকেছে। অবশ্য মেঘগুচ্ছ কেমনজানি অদ্ভুদ লাগছে। কচি নরম ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রুবেল। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে খোলা আকাশের দিকে।

ওই তো, মেঘের ওই অংশটুকু যেন হাতির মতো। আর ওই যে একেবারে বাম পাশের মেঘটুকু, বিশাল সাইজের গরুর মতো। এমন সাইজের একটা গরু এলাকার ছামাদ কাকুর দোকানে দেখেছে আজ ভোরে। অবশ্য এতক্ষণে হয়তো জবাই দিয়ে কেটে কুচিকুচি করে ফেলেছে গরুটাকে। রুবেলের মন খারাপ হয়। এটা নিয়ে আর ভাবতে চায় না।

তার চেয়ে একেবারে নাক বরাবর যেই মেঘটুকু আছে, সেটাকে দেখতে বেশ মজা লাগছে রুবেলের। এটা ঠিক টমির মতো। টমি রুবেলের সবচাইতে কাছের বন্ধু। চার পাওয়ালা একমাত্র বন্ধু। কারণ টমি তো কুকুরছানা।

নীলা, মনির, সাকিল, মিরাজ ওরা সব চলে এসেছে। রুবেলকে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে মনিরের সে কি হাসি। এই ছেলেটার মাথায় সমস্যা আছে, রুবেল মনে মনে বলে। কিছু একটা হলেই হা হা হি হি শুরু হয়ে যায় মনিরের।

তাগাদা দিল সাকিল। অনেক বেলা হয়ে গেছে। নিজেদের চাইতেও বড় বস্তা কাঁধে চাপিয়ে পাশের রেলস্টেশনের দিকে ছুটে চলল ওরা। টোকাইয়ের জীবন একটা সংগ্রামময় জীবন। রুবেলদের বয়সও কম। ওদের সবারই বয়স নয় কি দশের ভেতর। বয়সে ওদের চাইতে বড় যেসব টোকাই আছে, তাদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। না হলে শতকষ্ট করেও দিনের ভাত জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর এসে পড়ে। খুব ক্লান্তি পায় রুবেলের। এখন পর্যন্ত পেটে কিছু পড়েনি। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। অপরদিকে বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মালপত্রও তেমন একটা জোগাড় করতে পারেনি। নীলা বুদ্ধি দিল যার যা আছে একসঙ্গে করে চিড়া-গুড় কিনে এনে খাওয়া যেতে পারে। রাজি হলো সবাই। মিরাজ সবার টাকা একত্র করে চিড়া-গুড় কিনতে গেল।

পরিত্যক্ত একটা মালগাড়ির নিচে গিয়ে বসল সবাই। বিশ্রাম নিচ্ছে। বাইরে অতটা রোদ না থাকলেও আজ খুব গরম পড়েছে। এরই ফাঁকে কোত্থেকে যেন মিতু এসে হাজির। ওদেরই সঙ্গে থাকে মিতু। কিন্তু কাজের সুবিধার জন্য এলাকা আলাদা করে নিয়েছে ওরা। মিতু থাকে অন্য একটা দলে।

‘কিরে মিতু, তুই এই সময়ে এখানে হঠাৎ?’ রুবেল প্রশ্ন করল।

‘তোর খোঁজেই আসলাম। তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি। দেখলে খুশি হয়ে যাবি।’ হাস্যোজ্জ্বলভাবে জবাব দেয় মিতু।

‘তাই নাকি? এই ভরদুপুরে আবার কী নিয়ে এসেছিস?’

রুবেলের প্রশ্নের উত্তর দিল না মিতু। ওর বস্তা থেকে রুবেলের জন্য আনা জিনিসটা বের করে দিল। রুবেল তো অবাক! আনন্দে চোখটা চকচক করে উঠল ওর। মিতু ওর জন্য সবুজ রং-পেনসিল এনেছে।

মালগাড়ির নিচ থেকে বেরিয়ে এসে আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিল রুবেল। মিতুর কাছ থেকে সবুজ রং-পেনসিলটা নিয়ে ঝটপট একটি কাগজ জোগাড় করে ফেলল। তারপর সবাইকে নিয়ে বসে গেল আঁকাআঁকিতে।

একবার গাছ আঁকে, একবার ঘর আঁকে, একবার পাখি আঁকে! অদ্ভুদ লাগে সেগুলো। সব কিছুই যে সবুজ। ওর আঁকাআঁকি দেখে সকলে হেসে ফেলে। রুবেলকে বলে এটা আঁকো ওটা আঁকো। রুবেলের আনন্দ দেখে কে!

এমন সময় মিতু জানাল রেলস্টেশনের পাশে যেই স্কুলটা আছে, সেখানে আজ স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই ছবি আঁকছে। ওখান থেকে ফেরার পথে রাস্তায় রং-পেনসিলটা কুড়িয়ে পেয়েছে মিতু।

এটার পর রুবেল আর স্থির থাকতে পারল না। সবাইকে রেখেই ঝেড়ে দৌড় লাগাল স্কুলের দিকে। মাঝপথে মিরাজের সঙ্গে দেখা। কিন্তু মিরাজের দিকে তাকালোই না রুবেল। ওর মতো ও দৌড়ে চলেছে। পেছন থেকে মিরাজ খুব ডাকল। বলল চিড়া-গুড় এনেছে খেয়ে যা। অথচ রুবেলের সেদিকে মনই নেই। ওকে যে করেই হোক দ্রুত স্কুলে পৌঁছাতে হবে।

স্কুলে পৌঁছে চক্ষু চড়কগাছ হলো রুবেলের। এ কী দেখছে সে? স্কুলের মাঠে প্রায় সকলেই বসে ছবি আঁকছে। স্কুলের পঁচিশ বছর উদযাপন উপলক্ষে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। ছেলেমেয়েরা তাই মনের আনন্দে ছবি আঁকছে। সবার কাছেই দারুণ দারুণ সব রং-তুলি।

রুবেল এগিয়ে যায়। চারপাশ ছোটাছুটি করে। দূর থেকে এক এক করে সবার আঁকা ছবি দেখতে থাকে। এত সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে খুশি হয়ে যায় রুবেল। হাসি গিয়ে কান পর্যন্ত ঠেকে। ছোটাছুটি করতে থাকে তো করতেই থাকে। কার ছবি রেখে কার ছবি দেখবে বুঝতেই পারে না।

রুবেলের ছোটাছুটি চোখে পড়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হারুন সাহেবের। রুবেলকে তিনি চিনেন। ছেলেটা মাঝে মধ্যেই এসে স্কুল পরিষ্কার করার কাজে সহযোগিতা করে। হারুন সাহেব রুবেলের চোখ দেখে বুঝে যান ওর ছবির প্রতি আগ্রহ আছে। তিনি এগিয়ে যান। রুবেলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ছবি আঁকবি তুই?’

রুবেল নিজের কানকে বিশ^াস করতে পারে না। স্যার ওকে ছবি আকার প্রস্তাব দিচ্ছে। আনন্দে চোখ ভিজে আসে রুবেলের। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। হারুন সাহেব হাসিমুখে ওকে নিয়ে বাকি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসিয়ে দেন। সাদা কাগজ দিলেন। রং-পেনসিল দিলেন। বললেন ছবি আঁকতে।

একসঙ্গে অনেকগুলো রং-পেনসিল হাতে পেয়ে হা করে রইল রুবেল। একটু সময় লাগল এটা বুঝতে যে ওর সঙ্গে যা ঘটছে তা স্বপ্ন নাকি বাস্তব। যখন বুঝল যা ঘটছে সবই বাস্তব, তখন আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে আঁকতে শুরু করে দিল। সময়ের কোনো হিসেব থাকল না। কল্পনার রাজ্য থেকে তুলে আনল সব চিন্তাভাবনা। মনের খুশিতে আঁকতে থাকল রুবেল।

একটা গুঞ্জন তৈরি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। অনেকেই বলাবলি করছে, এতটা সুন্দর করে ছেলেটা আঁকল কীভাবে? প্রতিযোগিতার নির্ধারিত সময় শেষ হয়। সকলের আঁকা ছবি জমা নেওয়া হলো। বাদ গেল না রুবেলের ছবিটাও। যদিও সে স্কুলের ছাত্র না। কিন্তু এটা নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি জানাল না।

শহর থেকে গুণী মানুষ এসেছেন বিচারক হিসেবে। ছবি বাছাই শেষ। এক ঘণ্টার বিরতি শেষে মঞ্চে বিচারকমন্ডলী ও অতিথিরা জমা হলেন। শুভেচ্ছা বার্তার পর শুরু হলো বিজয়ীদের নাম ঘোষণা।

তৃতীয় স্থান বিজয়ীর নাম ডাকা হলো। বিজয়ী গিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করল। দ্বিতীয় স্থান বিজয়ীর নাম ডাকা হলো। এবারও বিজয়ী গিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করল। এরপর ডাকা হলো প্রথম স্থান অর্জনকারী বিজয়ীর নাম।

দর্শকদের ভিড়ের মাঝখান থেকে কান্নারত রুবেলকে নিয়ে আসা হলো মঞ্চে। তার হাতে তুলে দেওয়া হলো চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার প্রথম স্থান বিজয়ীর পুরস্কার। হারুন সাহেব রুবেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওর কাঁধে হাত রেখে মাইকে ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে রুবেলের পড়ালেখার সব দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষ বহন করবে। শুধু তাই নয়, রুবেলের মতো আরো যারা সুবিধাবঞ্চিত শিশু রয়েছে, তাদের সকলের পড়ালেখার দায়িত্ব নেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

রুবেল নিজেকে আটকাতে পারে না। পুরস্কার নিয়ে ছুট লাগায় নিজের বন্ধুদের উদ্দেশে। সবাইকে গিয়ে বলতে হবে আনন্দের সংবাদটা। স্কুল ওদের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন থেকে ওড়াও পড়বে, লিখবে, আঁকবে।

ওদের জীবনটা বদলে যাবে। অনেক সুন্দর হবে। আঁকা ছবির মতোন সুন্দর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close