বিশেষ প্রতিনিধি

  ১৯ অক্টোবর, ২০১৭

সীমানা পুনর্বিন্যাস, সেনা মোতায়েন ও ইভিএম

আওয়ামী লীগ-বিএনপি পাল্টাপাল্টি অবস্থানে

বহুল কাক্সিক্ষত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শেষ বললেই চলে। বিশেষ করে সবার নজর ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে বিরোধী দল বিএনপির দিকে। গত রোববার ও গতকাল সেই সংলাপও শেষ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এই দুই দলের ভাবনা ও অবস্থান স্পষ্ট হলো। সংলাপ শেষে অন্তত তিনটি ইস্যুতে দল দুটি তাদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের জানান দিল। ইসির কাছে দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী ইভিএম, সেনা মোতায়েন ও সীমানা পুনর্বির্ধারণের ব্যাপারে দল দুটি ভিন্ন অবস্থান ব্যক্ত করেছে।

এর আগে সংলাপে অংশ নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা তাদের প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। সেখানেও এই তিন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব এসেছে। এখন বাকি দুই দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) ও জাতীয় পার্টির (জেপি) সংলাপ আজ অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া অবশিষ্ট বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে দুটি সংলাপের মধ্য দিয়েই শেষ হবে ইসির সংলাপ পর্ব।

ফলে সংলাপে উঠে আসা নানা প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভিন্নমুখী অবস্থান কীভাবে সমাধান করবে ইসি, সেদিকেও যেমন নজর সবার; তেমনি সংকট সমাধানে কী ভূমিকা নেবে সরকার, সেদিকেও তাকিয়ে সবাই। দাবি পূরণ না হলে নির্বাচনী রাজনীতি কেমন হবে এবং এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা নিয়েও নানা বিশ্লেষণ চলছে। এর আগে সংলাপে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চেয়েছেন। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় এনে নির্বাচনে অংশ নিতে ইসিকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে বলেও মত দিয়েছেন তারা। তারা এমনও বলেছেন, ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে আস্থায় আনায় হবে ইসির মূল চ্যালেঞ্জ।

যদিও এর আগে সব দলকে নির্বাচনে আনতে ‘মধ্যস্থতার’ ভূমিকা নিতে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সুপারিশ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সিইসি। এমনকি নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দেখা দেওয়া দ্বন্দ্ব নিরসনে ‘সমঝোতার’ চেষ্টাকে ‘অযথা সময় নষ্ট’ বলেও মন্তব্য ছিল তার। কিন্তু গত কয়েক দিনে সে প্রেক্ষাপট কিছুটা বদলেছে। গত শনিবার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় সদিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির মনোভাবও ইতিবাচক। গত রোববার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপ শেষে দলটি আগামী নির্বাচন ও আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কিছুটা আশাবাদী হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে আয়োজিত সংলাপের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) আশা দেখছে সব দলের অংশগ্রহণেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের। স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা গত শনিবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দেখা দেওয়া নির্বাচনের এই তিন ইস্যুর ভিন্নমুখী অবস্থানের সমাধান কীÑজানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাটাই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। কোনো দল যেন নির্বাচন বয়কট না করে। আইনের বাইরে গিয়ে ইসিকে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরি করতে হবে।

গতকাল সংলাপে অংশ নিয়ে ১১টি নির্বাচনী সুপারিশ করেছে আওয়ামী লীগ। দলটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালুর পক্ষে মত দিয়েছে। তবে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বির্ধারণের বিরোধিতার পাশাপাশি ভোটের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে দলটি। অন্যদিকে এর আগে রোববার সংলাপে অংশ নিয়ে এর ভিন্নমুখী প্রস্তাব করেছে বিএনপি। দলটি ইভিএম চালু না করা, ২০০৮ সালের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়া ও ভোটে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব করে।

গতকাল সীমানা পুনর্নির্ধারণের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি বিশেষ করে আদমশুমারির সঙ্গে সম্পর্কিত। সর্বশেষ ২০১১ সালে আদমশুমারির (২০১৩ সালে প্রকাশিত) ওপর ভিত্তি করে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। নতুন আদমশুমারি ছাড়া পুনরায় সীমানা পুনর্বিন্যাস কার্যক্রম নিলে বিভিন্ন আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বিএনপি এর পাল্টা প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, ১৯৮৪ সালে গেজেটের মাধ্যমে ৩০০ সংসদীয় আসন বিন্যাস করা হয়েছিল। এরপর ১৯৮৬, ৮৮, ৯১, ৯৬ (দুবার) ও ২০০১ সাল পর্যন্ত ছয়টি নির্বাচন হয়। সংসদীয় আসন নিয়ে কোনো দল বা ব্যক্তি আপত্তি তোলেনি। সুতরাং ২০০৮ সালের আগে যে আসনের ভিত্তিতে নির্বাচন হয়েছিল, সে বিন্যাস অনুযায়ী নির্বাচন দিতে হবে।

ইসি সূত্রমতে, ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। ওই বছর নবম সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৩৩ আসনে সীমানা পরিবর্তনের প্রস্তাব করে ইসি। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন এ টি এম শামসুল হুদার কমিশন সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যার আনুপাতিক হার মেনে আঞ্চলিক অখন্ডতা ও প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে জিআইএস পদ্ধতি অনুসরণ করে শতাধিক সংসদীয় আসনে পরিবর্তন আনে। এরপর দশম সংসদ নির্বাচনে ৮৭ আসনে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয় আর কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ কমিশন আগের ইসির পদাঙ্ক অনুসরণ করে ৫০টি আসনে ছোটখাটো পরিবর্তন আনে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ বলছে ২০০৮ সালের সীমানায় নির্বাচন এবং বিএনপি বলছে ২০০৮ সালের আগের সীমানা ধরেই আগামী নির্বাচন হতে হবে। এটি ২০০৮ সাল কিংবা তার আগের নয়; এটি ২০১৭ সাল। তাই বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে ইসিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

একইভাবে আওয়ামী লীগ ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে চেয়েছে। গতকালের প্রস্তাবে বলা হয়, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন এবং ইসি নির্ধারিত ভোটের পরবর্তী সময়ের জন্য প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর ওপর ন্যস্ত থাকবে। কিন্তু বিএনপি এর আগে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনীকে মোতায়েনের প্রস্তাব করেছে।

তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী সেনা মোতায়েনে বিএনপির দাবির কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায়নি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় পুলিশ, আর্মড পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীর কথা নেই। ২০০৯ সালে আরপিও সংশোধনীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’, তারা ক্যাম্পে অবস্থান করবে, প্রয়োজনে তাদের ডাকা যাবে।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেন, সেনা মোতায়েনের প্রশ্নে কোনো রাজনৈতিক দলেরই মাথাব্যথা থাকা উচিত নয়। নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

একইভাবে বিএনপির পাল্টা অবস্থান নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালুর পক্ষে মত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপি বলছে, এ যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট কারচুপির সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া এ যন্ত্রের ওপর কোনো ভরসা করা যায় না। সে কারণে তারা নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনের বাকি রয়েছে আর মাত্র দেড় বছর। এই অল্প সময়ে তিন লাখ ইভিএম যন্ত্র তৈরি করা কী করে সম্ভব। তবে ইভিএম হোক বা ডিভিএম হোক; তা যদি সঠিকভাবে চালানো যায় তাহলে কারচুপি হয় না, এ নিয়ে বিএনপির আপত্তি থাকার কথা নয়। তা ছাড়া আমাদের আমলে যে ইভিএম আমরা প্রস্তুত করেছিলাম, শুনেছি সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এখন নাকি ইসি আরো উন্নত ডিভিএম মেশিন প্রস্তুতের চিন্তা করছে। এ মেশিন নাকি আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোটার শনাক্ত করবে। তবে আগামী নির্বাচনের আগে যেখানে দেশের সব ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড পৌঁছাতে পারবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে, সেখানে এত কম সময়ে ইভিএম বা ডিভিএম তৈরি করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আবার বিগত দশম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি এমনিতেই অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। তাই ইভিএম বিতর্কে আবারো বিএনপি যাতে নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ায় তা ইসিকে ভাবতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist