নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

পরিবেশ বাঁচিয়ে চামড়াশিল্পের প্রসারই বড় চ্যালেঞ্জ

* ট্যানারি সরানোর পরও বাড়েনি রপ্তানি * প্রতিনিয়তই বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদীসহ নানাভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ

চামড়াশিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য নদী-নালাসহ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে দূষণ। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে এ শিল্প হারাচ্ছে বড় বাজার। হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরের পর সাভারে পরিস্থিতি উন্নতি হবে বলে আশা করা হলেও বাস্তবে তা ঘটেনি। যার খেসারত দিচ্ছে পুরো খাত। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবির) তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চামড়া খাতের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আয় এসেছে ৮৯৫.২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের আয়ের তুলনায় ১৪.৩৮ শতাংশ কম। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত আয় এসেছিল ৮৩২.৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়। বৈশ্বিক বাজারের কথা মাথায় রেখে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। সে অনুযায়ী ২০০ একর জমি নিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় গড়ে উঠে চামড়া শিল্পনগরী। বর্তমানে এখানে ১৪১টি ট্যানারি রয়েছে। যেখানে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) তৈরি করা হয়। তবে সেটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো এলডব্লিউজি সনদ পাচ্ছে না। গত ২১ বছরের মধ্যে শুধু ২০২৩ সালের নভেম্বরে এলডব্লিউজি স্বীকৃতি পেয়েছে ‘সিমোনা ট্যানিং’ নামে একটি কারখানা। তাদের নিজস্ব ইটিপি রয়েছে। আর বাকিরা কেউই পায়নি এ সনদ। ফলে সার্বিক রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে এ খাত।

বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্টরা কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানালেও সমাধান হয়নি। প্রতিনিয়তই ট্যানারির বর্জ্যে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীসহ নানাভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, যা ঈদুল আজহার সময় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তবে এবার পরিবেশ দূষণরোধসহ সিইটিপির বিষয়টি সমাধানে জোরালো পদক্ষেপের আশ্বাস দিলেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি ট্যানারিতে সশরীরে উপস্থিত হন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার ভৌমিক। চামড়া শিল্পনগরীর নানা বিষয় নিয়ে কারখানা মালিকসহ এ খাতসংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের সঙ্গে আলাপ করেন তারা। সেখানে উঠে আসে নানা বিষয়। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা সাংবাদিকদের সঙ্গেও আলাপ করেন।

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, চামড়া শিল্পনগরীর এ সমস্যা নিয়ে বিসিকের যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা এখানে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া চামড়াশিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ট্যানারি মালিকরা উপস্থিত ছিলেন। আজকে আমরা কথাগুলো শুনেছি। মূলত সমস্যাগুলো শোনার পর সেগুলো সমাধানের জন্য আমরা রেজমিনে বিষয়গুলো দেখেছি। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কী করা যায়, সেটি নিয়ে আমরা আলোচনা করব। সমাধান হিসেবে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছি। এক দিনে আসলে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এছাড়া সবকিছু বন্ধ করে দিয়েও এ সমস্যার সমাধান এখন আমরা করতে পারছি না।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ইটিপি সহজ করা হয়েছে।শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিক থেকেও বলে দেওয়া হয়েছে, যেকোনো মালিক নিজের টাকায়, নিজের কারখানায় যদি ইটিপি করতে চান, এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। আগে বাধা ছিল। তবে এখন আর সেই বাধা নেই। আগে এ শিল্পনগরে চাইলেই নিজ উদ্যোগে ইটিপি করতে পারত না। তবে এখন সেটি করতে পারবেন। আর চামড়া খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সমস্যা চিহ্নিত করে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হবে বলে জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, সমস্যার সমাধানের আগে আসলে আমাদের যে বিষয়টি জানার দরকার ছিল, সেটি হলো- সমস্যাটা কি, সমস্যাটা কীভাবে হচ্ছে? আজকে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা সমস্যা নির্ধারণ করতে পেরেছি। মৌলিক কোনো জায়গায় ছাড় হবে না। পরিবেশের ক্ষতি করে জনস্বাস্থ্যকে আরো ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া, এ ধরনের নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস হবে না।

এদিকে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভার আধুনিক চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের সাত বছরে রপ্তানি তেমন একটা বাড়েনি। ২০১৭ থেকে ২০২৩ প্রতি বছরেই রপ্তানি ঘুরপাক খেয়েছে ১ থেকে সোয়া ১ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই। উল্টো স্থানান্তর প্রক্রিয়াতেই বন্ধ হয়েছে ৬৫টি ট্যানারি।২০১৭ সাল পর্যন্ত হাজারীবাগে চালু ট্যানারি ছিল ২২০টি। তবে বুড়িগঙ্গা দূষণের দায়ে এবং আদালতের রায়ে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল ট্যানারিগুলো বন্ধ করে দেয় সরকার।এরপরই ট্যানারিগুলো স্থানান্তর করা হয় সাভার আধুনিক চামড়া শিল্পনগরীতে। তবে সেখানে যেতে পারেনি সব প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, হাজারীবাগে চালু ২২০টি ট্যানারির বিপরীতে সাভারে সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার স্কয়ার ফিটের ২০৫টি প্লট তৈরি করে বিসিক। পরে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে প্লটের আকার পরিবর্তন করে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫৫ ট্যানারিকে। এর মধ্যে উৎপাদনে টিকে আছে ১৩০ ট্যানারি।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো. শাহীন আহমেদ বলেন, আমাদের যেসব ব্যবস্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা, আদৌ সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি।অথচ হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের সময় জোরগলায় বলা হয়েছিল কেন্দ্রীয় বর্র্জ্য শোধনাগারসহ সাভার আধুনিক চামড়া শিল্পনগরী পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু বাস্তবে শিল্পনগরীটি কমপ্লায়েন্স হতে না পারা এবং পাশের ধলেশ্বরী দূষণের দায়ে চামড়া রপ্তানি বাড়েনি, একই সঙ্গে কিছু ট্যানারি বন্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রেজোয়ানা হাসান বলেন, বিসিক ক্ষুদ্রশিল্প নিয়ে কাজ করে। বিসিক কেন ট্যানারি শিল্পের নিজে দায়িত্ব নিতে গেল শিল্পনগরীটির বেহাল দশার জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবও দায়ী, তবে এখনো চামড়া শিল্পনগরীটিকে আধুনিক ও পুরোপুরি কার্যকর করার সুযোগ আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close