কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ১৯ জুন, ২০২২

চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে নিহত ৪, আহত ১২

বড় ধরনের পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর বড় অংশ। এরই মধ্যে গত শুক্রবার মধ্যরাতে নগরীর ফয়’স লেক ও লেক সিটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা গেছেন চারজন। আহত হয়েছেন ১২ জন।

পাহাড়ের যে অংশ কাটা রয়েছে, চার দিন ধরে থেমে থেমে টানা বর্ষণের কারণে তা দ্রুত নিচের দিকে নেমে আসছে। নগরীর নাসিরাবাদ এলাকা থেকে সীতাকুন্ড ও হাটহাজারী এলাকা পর্যন্ত পাহাড়ের বড় অংশ খণ্ড খণ্ডভাবে কাটা। পাহাড়ের খাঁজে ঘরবাড়ি করে বাস করছে হাজারো পরিবার। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় ও পাহাড়ের পাদদেশে গর্তগুলোতে পানি জমে যাওয়ার কারণে বড় ধরনের পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্যমতে, পাহাড়ের খাঁজে বাস করছে ৮৩৫ পরিবার। কিন্তু বাস্তবচিত্র অন্যরকম। পাহাড়ে বাস করা পরিবারের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত গিয়ে কাছের পাহাড়ে অবস্থানকারীদের উচ্ছেদ করলেও বড় অংশ রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ এসব পাহাড়ে বাস করা ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সন্ত্রাসীরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর ধরে সরকারি খাস জায়গার পাহাড়ে বড় অংশই অবৈধ দখলে নিয়ে তারা নিয়ন্ত্রণ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামে পৃথক এলাকায় পাহাড় ধসে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন ১২ জন। শুক্রবার রাত ২টায় নগরীর আকবর শাহ থানার ১ নম্বর ঝিল এলাকা এবং গতকাল শনিবার ভোর ৪টায় ফয়’স লেক সি-ওয়ার্ল্ড গেট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মৃতরা হলেন ওই এলাকার ফজলুল হকের মেয়ে শাহিনুর আকতার (৩০) ও মাহিনুর আকতার (২০)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন তাদের মা রানু বেগম (২৮) ও বাবা ফজলুল হক (৭০)। নগরীর লেকসিটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা গেছেন আমিনুর রহমানের ছেলে লিটন (২৩) ও ইমন (১৪)। নগরীতে বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বড় ধরনের পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সকাল থেকে নগরীর পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সহকারী কমিশনার ভূমি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মাইকিং করছেন। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এদিকে সহকারী আবহাওয়াবিদ শেখ হারুনুর রশীদ জানান, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয় প্রভাবের কারণে চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও বজ্রপাতসহ ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের আশঙ্কা রয়েছে। আগামী ২০ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। এ অবস্থায় নদীবন্দরগুলোর জন্য ২ নম্বর সতর্কসংকেত জারি করা হয়েছে।

সূত্রমতে, ৪০ বছর আগে চট্টগ্রাম নগরীতে ২০০ পাহাড় ছিল। যার ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্থানীয় সংশ্লিষ্টরা বলেন, চট্টগ্রামে বর্তমানে টিকে থাকা পাহাড় রক্ষার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিডিএ ও সিটি করপোরেশন এক হয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার বিকল্প নেই। গত ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৯ জন মারা যাওয়ার পর শক্তিশালী পাহাড় রক্ষা কমিটির প্রদত্ত সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পাহাড় রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার করা মামলায় বিগত ১৯ মার্চ ২০১২ সালে সুনির্দিষ্ট রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। রায়ে পাহাড় কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ে নির্মিত স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশাসন হাইকোর্টের সেই আদেশ বাস্তবায়ন করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামান বলেন, পাহাড় হচ্ছে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় খুঁটির মতো। যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিহত করার পাশাপাশি মানুষ এবং জীববৈচিত্র্যের সুপেয় পানির আধার। ক্রমাগত পাহাড় ধ্বংস হয়ে গেলে চট্টগ্রাম মহানগরী পরভূমিতে পরিণত হবে। ক্রমবৃদ্ধিমান ইট-ক্রংক্রিটের সৃষ্ট উত্তাপ পরিশোধন করার বিকল্প না থাকায় নগরীর তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। পাহাড় কেটে আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন করে মানুষ যতটুকু আর্থিক লাভবান হচ্ছে, বাস্তবে প্রাকৃতিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, নগরীর ১৩টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে দেড় হাজারেরও বেশি পরিবার বাস করছে। গত কয়েক বছরে পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে মারা গেছে দুশরও বেশি মানুষ। ২০০৭ সালের ১১ জুন স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধস ট্র্যাজেডিতে ১২৭ জন মারা যায়। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত হয় ১১ জন। ২০১১ সালে নগরীর বাটালী হিলে পাহাড় ধসে ১১ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২০১২ সালের ১ জুলাই নগরীর বাটালী হিল পাহাড়ের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে প্রাণ হারায় ১৭ জন। নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়চাপায় মারা যায় ২৪ জন। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৪ জুন পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ৩৭ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বর্তমানে চট্টগ্রামে যেভাবে ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে, তাতে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অব্যাহত পাহাড় কাটার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে চট্টগ্রামের বেশকিছু পাহাড়। এরমধ্যে জেলা প্রশাসন যেসব পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সেগুলো হচ্ছে, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ পশ্চিম কোণের পাহাড়, সিআরবির পাদদেশ, টাইগারপাস-লালখান বাজার রোডসংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুলসংলগ্ন পাহাড় ও আকবর শাহ আবাসিক এলাকাসংলগ্ন পাহাড়। সড়ক ও জনপথ, রেলওয়ে, গণপূর্ত ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালউ হিলসংলগ্ন পাহাড়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন পরিবেশ অধিদপ্তরসংলগ্ন পাহাড় ও লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকায়। বাকি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় হচ্ছে- বনবিভাগের বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন পাহাড়। ইস্পাহানী গ্রুপের ইস্পাহানী পাহাড়। জেলা প্রশাসনের ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড় মোড়সংলগ্ন পাহাড়, এ কে খান কোম্পানির এ কে খান কোম্পানি পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কৈবল্যধামস্থ বিশ্ব কলোনির পাহাড়, লালখান বাজার পাহাড়, চান্দমারি রোডসংলগ্ন জামেয়াতুল উলুম ইসলামী মাদরাসাসংলগ্ন পাহাড়, সরকারি (এপি সম্পত্তি) নাসিরাবাদ শিল্প এলাকাসংলগ্ন পাহাড়।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামে পাহাড় দখলের প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নামসর্বস্ব সংগঠন পর্যন্ত। দখলদারদের তালিকায় রয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। বাদ যাননি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার একর পাহাড় দখলের পর তা কেটে পরিণত করা হয়েছে সমতল ভূমিতে। সীতাকুণ্ডে পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। এমনকি প্লট তৈরি করে বিক্রির ঘটনাও ঘটছে। জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। ফলে বাড়ছে পাহাড় ধসের ঝুঁকিও।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close