নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সরকারের ১০০ দিন

অর্থনীতি রাজনীতির যত চ্যালেঞ্জ

দেশে টানা চতুর্থ দফা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এ মেয়াদে সরকারের প্রথম ১০০ দিন পূর্ণ হলো গতকাল শনিবার। প্রথম ১০০ দিন নিয়ে সরকারের ঘোষিত কর্মসূচি না থাকলেও ছিল বেশকিছু উদ্যোগ। রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে স্বস্তিতে কেটেছে রমজান মাস। শাকসবজি, পেঁয়াজ ও ফলমূলসহ স্থানীয় মৌসুমি ফলের দাম ছিল নিম্নমুখী। ব্যাপকভাবে কমেছিল তরমুজের দাম। চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, গম ও আটার দাম অপরিবর্তিত ছিল। জিরার পাশাপাশি দেশি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদসহ কয়েকটি মসলার দামও কম ছিল। তবে নানা কারণে ‘রিজার্ভ কমে যাওয়া’, ‘মূল্যস্ফীতি’ নিয়ে ভুগছে দেশের অর্থনীতি। সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিনে এ ধরনের নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে শুরু করে নিরাপত্তা, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে সরকারের আরো চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। শনিবার রাজধানীর ঢাকা গ্যালারিতে এডিটরস গিল্ড আয়োজিত ‘সরকারের ১০০ দিন : অর্থনীতি রাজনীতির চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা জানান আলোচকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘এ সরকার কিন্তু একেবারে নতুন নয়। আগের সরকারেরই ধারাবাহিক। যদিও সরকারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে রদবদল দেখেছি। সরকারের অর্থনৈতিক নীতি এবং নীতি প্রয়োগের যে প্রক্রিয়া, সেদিকে তাকালে আমার মনে হয় না খুব বড় কোনো পরিবর্তন হয়েছে। আরেকটি দিক হচ্ছে, বড় ধরনের অর্থনৈতিক যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে গত দুই বছর ধরে; বিশেষ করে করোনা পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সামষ্টিক অর্থনীতির যে নানা অস্থিতিশীলতা, এটার প্রকাশ নানাভাবে হচ্ছে।’ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুব অল্প সময়ের মধ্যে অর্ধেকের কমে নেমে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আরো যদি আমরা রাজস্ব আদায়ের দিকে তাকাই- সরকারের বড় যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াগুলো দেখলে আমার কাছে মনে হয়, আগের সরকারের প্রক্রিয়া থেকে তেমন কোনো সরে আসা হয়নি। বরং কোনো কোনো জায়গা আমাদের উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়েছে।’

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘আগামীতে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। এর মূল কারণ হচ্ছে সরকার অনেক ঋণ করেছে বিদেশ থেকে। এ টাকা পরিশোধ করা এত সহজ হবে না। কয়েকদিন আগে দেখলাম রাশিয়াকে অনুরোধ করছে সরকার যে টাকা দুই বছর পরে নেওয়ার জন্য। আমাদের হাতে কি জাদু আছে যে, দুই বছর পরে আমাদের সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে? বরং আমরা যেটা নিয়ে সরকার যে পাঁচণ্ডছয় বছর ধরে ঋণ নিচ্ছিল, এগুলো কিন্তু আমাদের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষতিকারক বলতে আমরা পরিশোধ করার সক্ষমতার বাইরে ঋণ করেছি। এখন যেমন পাকিস্তান একটা ঋণ নিয়ে আরেকটা শোধ করছে, বাংলাদেশের অবস্থা যদি সেদিকে যায়, আমি সরকারকে অনুরোধ করব ইন্টারন্যাশনাল সোর্স থেকে আর যেন ঋণ না করে। আইএমএফ বলেছে, বাজেট ছোট রাখার জন্য, এটা আমার কাছে মনে হয় ঠিক আছে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘গত ১০০ দিনের মধ্যে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ হাইজ্যাক হয়েছিল সোমালিয়ার জলদস্যু দ্বারা। সেখানে তাদের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। এটা নিয়ে ইইউ প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা যেসব অজুহাত দিয়েছে, এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। তারা যথেষ্ট সাবধান ছিল না, যেসব সাবধানতা অবলম্বন করার কথা ছিল তারা করেনি। শুধু আত্মসমর্পণ করে জাহাজটি তাদের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে, এটা অনেক বড় ব্যর্থতা।’ ইশফাক ইলাহী চৌধুরী আরো বলেন, ‘সরকারের ১০০ দিনে আরো ঘটনার মধ্যে আছে কুকি চিনের তৎপড়তা। আগে থেকে সক্রিয় থাকা একটি গোষ্ঠী বিরাটভাবে আত্মপ্রকাশ করলো বান্দরবানে। ঘটনার সময় বিজিবির সদস্যরা সেখানে ছিল, তাদের সামনে দিয়েই চলে গেল ব্যাংক লুট করে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলো না। এগুলার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। এখন সেনাবাহিনী গেছে, অভিযান চলছে, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা ভুগছে। একই সময়ের মধ্যে হিজবুত তাহরির একটা উত্থানের বিষয় দেখা গেছে। এগুলো আমার কাছে মনে হয় আমাদের অভ্যন্তরীণ দীর্ঘমেয়াদি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে।’

সাংবাদিক শওকত মাহমুদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়েছে। নির্বাচন হয়েছে তিন মাসও হয়নি, এর মধ্যে যদি চক্রান্ত দেখতে শুরু করে, তাহলে সংকটটা কী এবং কোথায়? কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে, সরকার নিজে নিজে কেন চক্রান্ত অনুভব করছে। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন মার্চে দেশে একটি দুর্ভিক্ষ ঘটানোর চক্রান্ত আছে। যাই হোক, মার্চ মাসে আমরা দুর্ভিক্ষ দেখিনি, চক্রান্ত কী ছিল জানলাম না। অতএব এ-চক্রান্ত তত্ত্বকে সামনে রেখে সরকার বারবার একটা রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো রাজনীতি এখন আসলে নেই। সরকার ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে আর বিরোধী দল ব্যস্ত হতাশা, দুর্বলতা কাটিয়ে কীভাবে মাঠে থাকা যায় সেই চেষ্টায়। ভারত বয়কট একটা সামাজিক আন্দোলন ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেখান থেকে বিএনপি নেতারা পিক করেছেন। কারণ বাংলাদেশে আসলে ভারতবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল নেই। ইসলামি দলগুলো এখন ভারতের বিরোধিতায় কিছু বলে না এখন।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘১০০ দিনের সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য আমি মনে করি সারা পৃথিবীর স্বীকৃতি এ সরকার পেয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা কিন্তু দেখছে না, সবাই এখানে বাণিজ্য করতে চাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখন কিন্তু বিএনপি কোনো বাধা নয়। কারণ তারা দল হিসেবে ভুল করেছে এবং তাদের অনেকেই এখন উপজেলা নির্বাচন করছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে যেত, তাহলে ৭৩ জনকে বহিষ্কারের চিঠি দিতে হতো না। এখন বিএনপি দল সামলাতেই ব্যস্ত। মাঠের কর্মীরা নির্বাচনমুখী, আর বিএনপি লন্ডনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে নাকি মির্জা ফখরুলের; সেটি নিয়ে ব্যস্ত। তৃণমূলের কেউ কিন্তু কেন্দ্রের নির্দেশ মানছে না। এটি কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। দলের সাধারণ সম্পাদক যখন প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে হুঁশিয়ারি দেন, সেটি কি কেউ মান্য করছে? হুঁশিয়ারি কাজে না দিলে আরেকটি প্রেস কনফারেন্স করে জানাতে হয়, তারা ব্যবস্থা নেবেন! বিএনপি বহিষ্কার করে দেখায় দিল, আগামী দিনে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত তৃণমূলে কেউ মানবে না, মন্ত্রী-এমপি মানবে না।’ আলোচনায় আরো অংশ নেন ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুুল মান্নান, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল এবং গবেষক ও আইনজীবী ড. ফারজানা মাহমুদ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close