কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ২১ জানুয়ারি, ২০২০

ঢাকা ও চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত দুই মামলার রায় : চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সভায় ২৪ জনকে গুলি করে হত্যা

৫ পুলিশের ফাঁসি

এই রায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ‘বড় সতর্কতা’

তিন দশক আগে চট্টগ্রাম বন্দর নগরীর লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনায় পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন আদালত। গতকাল সোমবার বিকেলে চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন চার আসামির উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদ- পাওয়া আসামিরা প্রত্যেকেই পুলিশের সদস্য। তারা হলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি অঞ্চলের তৎকালীন পেট্রল ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দাস, পুলিশ কনস্টেবল মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহ আবদুল্লাহ ও হাবিলদার প্রদীপ বড়–য়া। মামলার অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত একজন পলাতক। বাকি চারজন কারাগারে আছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘অতি-উৎসাহী’ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর কোনো বাহিনী কিংবা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন অতি-উৎসাহী হয়ে ভবিষ্যতে কোনো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটাতে না পারে, এ রায় তার জন্য ‘বড় সতর্কতা।’ তারা যেন অতি-উৎসাহী হয়ে কোনো পদক্ষেপে না যান, সে বিষয়ে এটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও ১৯৮৮ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। এ আন্দোলনকে বেগবানের জন্য ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে আসেন। আগে থেকে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে এরশাদবিরোধী জনসমাবেশের স্থান ছিল। সকাল থেকে লালদীঘিতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পথে পথে ছিল হাজার হাজার মানুষ। তৎকালীন ১৫ দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম আসছেন শুনে হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা অবস্থান নেয় নগরজুড়ে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট চত্বরে অপেক্ষারত ছিলেন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। ওইদিন দুপুর দেড়টার দিকে মিছিল নিয়ে শেখ হাসিনা কোতোয়ালি থানা হয়ে পুরোনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন অতিক্রম করার সময় এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয়। সমাবেশ বানচাল করে দিতে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশে পুলিশ বাহিনী গুলি চালায়। এ সময় দলের নেতাকর্মীরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে নেত্রীকে বাঁচাতে মানববর্ম রচনা করেন। আইনজীবী ভবন থেকে নেমে আসেন আইনজীবীরা। তারা শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে আইনজীবী ভবনের দিকে নিয়ে যান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিত গুলিতে ২৪ জন বেসামরিক লোক নিহত হন। আহত হন আরো দুই শতাধিক। পুলিশের গুলিতে যারা মারা যান মোহাম্মদ হাসান মুরাদ, সীতাকু- থানা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীম, ছাত্রনেতা স্বপন কুমার বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এথেলবাট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, খেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, হোটেল শ্রমিক জি কে চৌধুরী, ছাত্রনেতা সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহারউদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মোহাম্মদ কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও শাহাদাত প্রমুখ।

অভিযোগ ওঠে, নৃশংসতা এমনপর্যায়ে যায়, পুলিশের কড়া পাহারায় নিহতদের লাশ রাতের আঁধারে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। চলে লাশ গুম করার চেষ্টা। এই ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা এবং কোতোয়ালি জোনের পুলিশ পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ্র চন্দ্র ম-লসহ ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলা করা হলেও অনেক বছর ধরে এ মামলার কোনো গতি হয়নি। বছরের পর বছর নীরবে কেটে যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বহুল আলোচিত এ মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। সিআইডি ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম দফায় সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদাকে আসামি করে। পরে আবার ১৯৯৮ সালে ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অধিকতর তদন্তের পর মীর্জা রকিবুল হুদাসহ আটজনকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হয়। ২০০০ সালের ৯ মে আদালত আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আসামিদের মধ্যে সবাই পুলিশ। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, সাজেদা চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদসহ ১৬৭ জন সাক্ষী ছিলেন। গত ১৪ জানুয়ারি ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণরে মধ্যদিয়ে কার্যক্রম শেষ হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত রোববার রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন। গতকাল আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করার কথা থাকলেও তারা অসম্মতি জানান। পরে আদালত বিকাল ৩টায় রায় পড়ে শোনান।

মামলার আইনজীবী ইফতার সাইমুল বলেন, মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জেসি ম-লসহ পাঁচজনের মৃত্যুদ- এবং ৩২৬ ধারায় ১০ বছরের সাজাসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত।

রায় ঘোষণার সময় আসামিপক্ষের কোনো আইনজীবী ছিলেন না। এদিকে রায় ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণে আনন্দ মিছিল করেন।

এ মামলার বিচার দেখে যেতে পারেননি বাদী শহীদুল হুদা। ২০১৩ সালে তিনি মারা যান। ২৪ জানুয়ারি নিহত এথেলবাট গোমেজের মেয়ে জানান, তার জন্মের দুদিন পরই গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তার বাবা। তার মা লুচিয়া গোমেজও মামলার বিচার দেখে যেতে পারেননি। তিনিও কয়েক বছর আগে মারা যান। তবে দীর্ঘদিন পর হত্যাকাণ্ডের বিচার পেয়ে তিনি সন্তুষ্ট।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close