মেহেদী হাসান

  ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

পোলট্রিশিল্পে সিন্ডিকেট

জনগণের পকেট কাটার নতুন ‘পাঁয়তারা’

রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারে মুরগি কিনতে যান ফরিদ আহম্মেদ। দোকানির কাছে কক মুরগির দাম শুনেই চমকে ওঠেন তিনি। রোজার শেষদিকে ১ কেজি কক মুরগি কিনেছিলেন ২৯০ টাকায়। গতকাল শুক্রবার সেই একই মুরগির দাম কেজিতে ৮০ টাকা বেড়ে ৩৭০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ ক্রেতার অভিযোগ, বাজারে মুরগির সংকট না থাকলেও ঈদে বৃদ্ধি পাওয়া মুরগির দাম এখনো বহাল থাকে কী করে! বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) বলছে, ১০ দিনের গরমে মুরগি মরে ২০০ কোটি টাকার লোকসান গুনেছেন প্রান্তিক খামারিরা। তাই দাম সহসা কমবে না। তবে এমন তথ্য নাকচ করে দিয়েছে খামারিদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ প্রান্তিক পোলট্রিশিল্প সংগঠন।

সংস্থাটির দাবি, দেশে পোলট্রি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে বৃহৎ এক সিন্ডিকেট। দেশি-বিদেশি ৩৫টি কোম্পানি দেশে রেডিফিড, বাচ্চা ও মাংস উৎপাদন করে। অন্যদিকে অর্ধশতাধিক কোম্পানি রয়েছে, যারা শুধু বাচ্চা এবং ফিড উৎপাদন করে প্রান্তিক খামারিদের কাছে বিক্রি করে। অভিযোগ রয়েছে, ৩৫টি কোম্পানি তাদের ডিম, মুরগি ও বাচ্চা উৎপাদনের পাশাপাশি মাংস উৎপাদন করে দাম নির্ধারণ করে- যাতে প্রান্তিক খামারিদের বাচ্চা ও ফিড সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো চাপে থাকে। সর্বশেষ করোনা-পরবর্তী সময়ে বাচ্চা ও ফিডের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় ঝরে পড়তে থাকেন প্রান্তিক খামারিরা। খামারির সংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকে। এ ঘাটতির সুযোগ নেয় ওই ৩৫টি কোম্পানি।

অভিযোগ রয়েছে, এ সিন্ডিকেট কোম্পানিগুলোর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন। সরকারের কাছে থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে প্রান্তিক খামারিদের নাম ব্যবহার করে তারা। প্রকৃতপক্ষে প্রান্তিক খামারিদের সহযোগিতার বদলে সিন্ডিকেটের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে সংগঠনটি। দফায় দফায় পোলট্রি ফিড, এক দিন বয়সি মুরগির বাচ্চা ও ডিমের দাম বাড়ানোর কারণে বন্ধ করে প্রান্তিক পর্যায়ের খামার। এ সিন্ডিকেটের তালিকায় নাম উঠে এসেছে কাজী, সিপি, প্যারাগন, আরআরপি, সগুনা, একাত্তর, ফিনিক্স, আফতাব, আকিজ গ্রুপ, নারিশ এগ্রোর মতো প্রতিষ্ঠান।

খামারিরা বলছেন, ২০২০ সালে ৫০ কেজির এক বস্তা ফিডের দাম ছিল ১ হাজার ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে একই খাদ্যের বস্তাপ্রতি দেড় হাজার টাকা বেড়ে দাম প্রায় সাড়ে ৩ হাজারে ঠেকেছে। ডিমের উৎপাদন মূল্য ৭ টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ১০ টাকা হয়েছে। মাংসের উৎপাদন খরচ বাড়ায় এক বছরের ব্যবধানে ১২০ টাকার ব্রয়লার মুরগি ২২০, সোনালি ২৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫০ এবং ২৬০ টাকার লেয়ার মুরগি ৩৪০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বড় বড় কোম্পানি। প্রান্তিক খামারি না থাকলে বাণিজ্যিক খামারগুলো তাদের উৎপাদিত ডিম, মুরগি ও বাচ্চা থেকে মাংস উৎপাদন করে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারবে।

খামারিদের দাবি, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের পক্ষ থেকে খামারিদের মুরগির বাচ্চা ও পোলট্রি ফিডে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখতে হবে- যাতে করে বাজারে সংকট তৈরি না হয়। প্রান্তিক খামারিদের করপোরেট কোম্পানির জিম্মি দশা থেকে মুক্ত করতে মুরগির বাচ্চা ও পোলট্রি ফিড বিদেশ থেকে আমদানির অনুমতি দেওয়ার দাবি জানান তারা। প্রান্তিক খামারি নওগাঁর বেলাল হোসেন জানান, করোনার পর খাদ্যের বস্তায় ১ হাজার ৪০০ টাকা বেড়েছে। গত মাসে ঈদে যা লাভ হয়েছে, করোনার আগে একই পরিমাণ মুরগি থেকে দ্বিগুণ লাভ হয়েছে। এলাকার ৮০ শতাংশ খামার বন্ধ। খামার করে একবার লাভ হয় তো দুবার লস। বেশিরভাগ টিকতে না পেরে পেশা বদলেছে। নারিশ কোম্পানি এখন খামার ভাড়া করে মুরগি উৎপাদন করে। খামারের মালিক এখন চাকরে পরিণত হয়েছে।

শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগি ২৩০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়েছিল। তবে বাজারগুলোয় সোনালির কেজি ৩৭০, সোনালি হাইব্রিড ৩৬০, দেশি মুরগি ৬৫০ থেকে ৬৮০, লেয়ার ৩৫০ এবং সাদা লেয়ার ৩৩০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুদিনের ব্যবধানে বাজারে সোনালি, দেশি ও লেয়ার মুরগির কেজিতে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের ঘোষণার পরই এমন দাম বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের তথ্যমতে, করোনা-পরবর্তী সময়ে পুঁজি হারিয়ে অনেক খামারিই উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ফিডের দাম বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এ সংখ্যা প্রতিনিয়তই বেড়েছে। করোনার পর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খামারিদের ঝরেপড়ার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৯ হাজার, যা দেশে পোলট্রি খামারিদের প্রায় অর্ধেক। এরপর আরো এক বছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫ হাজারে।

জাতীয় পোলট্রি নীতিমালা-২০০৮-এর তথ্যানুযায়ী, দেশে ডিম উৎপাদন বাণিজ্যিক ও গ্রামীণ পোলট্রি অনুপাত প্রায় সমান সমান এবং মাংস উৎপাদন অনুপাত ছিল ৬০:৪০। বর্তমানে প্রান্তিক পোলট্রিশিল্প সংগঠনের তথ্য বলছে, বাণিজ্যিক ও গ্রামীণ পোলট্রি উৎপাদন অনুপাত ৯৫:৫। চলতি এ গরমে প্রান্তিক খামারিদের সারা দেশে প্রায় ১০ কোটি টাকার ব্রয়লার মুরগি মারা গেছে। লোডশেডিংয়ে প্রায় ১৫ কোটি টাকার লেয়ার মুরগি মারা যাওয়ায় ডিম উৎপাদন কমেছে। ২০২২ সালের পর থেকে খাদ্য ও বাচ্চা উৎপাদনকারী ৩৫টি করপোরেট কোম্পানির গভীর ষড়যন্ত্রে লাগামহীন খাদ্য ও বাচ্চার দাম বৃদ্ধি করে দেশের ৯৫ শতাংশ প্রান্তিক খামারির খামার ব্যবসা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এ সুযোগ নিয়েছে বাণিজ্যিক পোলট্রি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

অন্যদিকে বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, গরমে গত ১০ দিনে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে খামারিদের। বিরাট অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় পোলট্রিশিল্পে বড় রকমের সংকট দেখা দিতে পারে। লোকসান পোষাতে শিগগিরই এক দিনের বাচ্চা, ডিম ও মুরগির দাম বাড়তে পারে। ঈদের পর থেকে শুরু হওয়া চলমান তাপপ্রবাহের ফলে সারা দেশে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ মুরগি মারা যাচ্ছে। যার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। ডিম ও মুরগি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডিম ও মুরগির দাম মারাত্মকভাবে বাড়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। বিপিএর তথ্যানুযায়ী, এ গরমে সবচেয়ে বেশি মুরগি মারা যাচ্ছে নরসিংদীতে। এ অঞ্চলে গত ১২ দিনে প্রায় ৩ লাখ, ময়মনসিংহ ও গাজীপুর অঞ্চলে ২ লাখ, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১ লাখ ৭৫ হাজার, যশোরে ১ লাখ ৫০ হাজার, চুয়াডাঙ্গায় ১ লাখ এবং সিলেট ও পাবনায় ৫০ হাজার মুরগি মারা গেছে।

বাংলাদেশ প্রান্তিক পোলট্রিশিল্প রক্ষা সংগঠনের চেয়ারম্যান মফিজুল ইসলাম মল্লিক বলেন, করপোরেট কোম্পানির উৎপাদন করা ব্রয়লার, লেয়ার, সোনালি মুরগি মারা যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। করপোরেট কোম্পানিগুলোর মুরগি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয়। প্রাণিসম্পদ বিভাগের ডাক্তাররা তাদের ফার্মে বিশেষভাবে তদারকি করে। অন্যদিকে প্রান্তিক খামারিদের খামারে সরকারি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কারণে প্রান্তিক খামারিদের সমস্যা বেশি। মারা যায় মুরগি। এখন একটি গোষ্ঠী গরমকে ইস্যু করে করপোরেট কোম্পানির মুরগি মারা গেছে বলে সরকারি অনুদানের জন্য বিভিন্নভাবে আর্থিক লোন ও প্রণোদনা পাইয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অথচ তদন্ত করে আসল প্রান্তিক খামারির কাছে পৌঁছে সহায়তা দেওয়া উচিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close