নওগাঁ ও দিনাজপুর প্রতিনিধি

  ০৮ মে, ২০২৪

‘উন্নয়নে’ উজাড় বৃক্ষ খাঁখাঁ আলতাদিঘী

দিনাজপুরে সড়কে কাটা পড়ছে শত শত গাছ * আলতাদিঘী পুনঃখননে কাটা হাজার গাছ

একদিকে চলমান ছিল তাপপ্রবাহ। অপরদিকে এরই মধ্যে চলছে বৃক্ষনিধন। নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার অতি প্রাচীন আলতাদিঘীর সবুজবেষ্টনী, চারপাশে প্রচুর গাছ-গাছালি জন্য বলা হতো এলাকার ফুসফুস। সেই দিঘীর উন্নয়নের জন্য এর চারপাশের হাজারখানেক গাছ কাটা হয়েছে। গাছ কাটার পর খাঁখাঁ করছে আলতাদিঘীর চত্বর। অপরদিকে, সড়ক প্রশস্ত করার জন্য দিনাজপুরে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে শত শত গাছ। দিনাজপুর জেলা পরিষদের প্রতিনিধিরা বলেছেন, সড়ক প্রশস্ত করতে সরকারি নিয়ম মেনেই এসব গাছ কাটা হচ্ছে। অতি তীব্র তাপপ্রবাহে যখন মানুষ অতিষ্ঠ। ঠিক সেই সময় এভাবে বৃক্ষনিধনের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইছে সমালোচনার ঝড়। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

নওগাঁ : ‘আলতাদিঘী পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ প্রকল্পে দিঘী খনন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ ও গাছ রোপণসহ বেশকিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। যা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাটা পড়ে ১ হাজার ২টি নানা প্রজাতির গাছ।

বন বিভাগ বলেছে, সামাজিক বনায়নের আওতায় রোপণ করা ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি প্রজাতির গাছগুলো অপসারণ করে স্থানটি দেশীয় প্রজাতির চারা দ্বারা প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা হয়েছে। আলতাদিঘির খননকৃত মাটি দিয়ে নিচু স্থান ও পাড় সংস্কার করার জন্য দিঘির চারপার্শ্বে বিদ্যমান ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনিগাছ যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ১৫টি লটে ৩৫ হাজার ৯৫ হাজার ২৫৬ টাকায় টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয়।

পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ অজুহাতে ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার বিষয়টি হয়তো মেনে নেওয়া যায় তবে দিঘির চতুর্দিকে সারিবদ্ধভাবে লাগানো পরিবেশবান্ধব বিশাল আকৃতির ৪৫৬টি আকাশমনিগাছ কাটার বিষয়টি অযৌক্তিক।

ধামইরহাটের বনবিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় গাছ কাটা হয়েছে। নতুন বনায়ন হবে, একটা গাছ তো আর সারাজীবন থাকবে না। এটি সামাজিক বনায়নের অওতায় স্বল্প মেয়াদি সৃজিত উডলট বাগান।

নওগাঁ জেলা শহর থেকে সাব্বির হোসেন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আলতাদিঘি দেখতে। এ প্রতিবেদককে তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দিঘিটি অবশ্যই সংস্কার জরুরি কিন্তু তাই বলে এভাবে নির্বিচারে গাছ কাটতে হবে? প্রশ্ন করেন তিনি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নওগাঁ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সৌন্দর্যবর্ধন বৃক্ষরোপণের মধ্যে নিহিত, নিধনে নয়। আজকের কর্তনকৃত গাছগুলো হতে সময় লেগেছে ১৫ থেকে ২০ বছর। অথচ কাটা হয়েছে এক নিমিষেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এবিষয়ে অনেক মিটিং মিছিল মানববন্ধন করেছি। কিন্তু এতে কাজ হয়নি।’

রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান জানান, দিঘিরপাড়ের ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছগুলো কেটে দেশীয় প্রজাতির ৩ হাজার চারা রোপণ ও পাড় মেরামত ও উঁচু করা হয়েছে। প্রকল্পটি ডিসেম্বর ২০২৪ সালে শেষ হলে পুরো আলতাদিঘি এলাকা আবারও সবুজে পরিণত হতে শুরু করবে।

আলতাদিঘির নামকরণে রয়েছে মজার লোকশ্রুতি। এলাকায় ছিল বটু রাজা, রানী দয়াবতী আবদার করলেন, দিঘি খুঁড়ে দিতে হবে। রাজা বললেন, ঠিক আছে। তুমি হাঁটতে শুরু কর। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার পা ফেটে রক্ত বের না হয় ততক্ষণ হাটা দূরত্ব পর্যন্ত দিঘি হবে। রাণী হাঁটতে থাকলেন। হাঁটা আর শেষ হয় না। রাজা পড়ে গেলেন চিন্তায়। তাই কৌশলে সৈন্য দিয়ে রাণীর পায়ে আলতা ছিটিয়ে দিলেন। বললেন, রানীর পা ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। ব্যাস দিঘি ওই পর্যন্তই খোঁড়া হলো। সে থেকেই এর নাম হয়েছে আলতাদিঘি। উত্তর-দক্ষিণে দিঘির দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার, চওড়া প্রায় ৪০০ মিটারের মতো। এটা বৌদ্ধ যুগের কীর্তি বলে অনেকে মনে করেন। শীতের সময় অতিথি পাখির আগমন ঘটে।

দিনাজপুর : জানা গেছে, ১৯৯০ সালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রাস্তার পাশে জেলা পরিষদ বোচাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে মেহগনি, বকাইল, পাকুড়, কদম, কৃষ্ণচূড়া, কাঁঠাল, আম, কামরাঙাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করে। সেই সড়কগুলো প্রশস্তকরণের কাজ শুরু করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। কিন্তু রাস্তা প্রশস্তকরণে জন্য গত ৪ ফেব্রুয়ারি জেলা পরিষদ বোচাগঞ্জ উপজেলার পুলেরহাট বাজার, মাধবপুর, ডাকবাংলা অডিটোরিয়াম মোড়, জালগাঁও, বকুলতলা এলাকায় ৭টি লটে ২৯৮টি গাছ বিক্রির ইজারা প্রদান করে। আর গত ১৬ এপ্রিল গাছ কাটার কার্যাদেশ প্রদান করে।

স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, রাস্তা প্রশস্ত করতে গিয়ে যে গাছ সীমানার মধ্যে পড়বে সেটা কাটুক। কিন্তু রাস্তা থেকে অনেক দূরের গাছগুলো কেন কাটা হচ্ছে? বাধা দিলে কোনো কথা শুনে না। তারা তো গাছ কেটে এলাকাকে মরুভূমি বানিয়ে দিয়েছে। রাস্তার গাছ কাটে কিন্তু নতুন করে রোপণ করে না।

পথচারী রবিন রায় বলেন, গরমের পর গাছগুলো কাটলে কি এমন ক্ষতি হতো? কিন্তু তারা এ গরমের মধ্যেও গাছগুলো কেটে সাবাড় করে দিল।

বোচাগঞ্জ উপজেলার সমাজকর্মী মাহবুব আলম বলেন, দিনাজপুর-সেতাবগঞ্জ সড়কে প্রায় ৫০ বছর আগে লাগানো শত শত গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সড়ক প্রশস্ত করা হোক তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। রাস্তা প্রশস্ত করা হবে দুদিকে তিন ফুট করে। কিন্তু রাস্তা থেকে ১০ ফুট দূরের গাছগুলোও কেটে ফেলা হচ্ছে। তার অভিযোগ, তাপপ্রবাহের মধ্যেও গাছগুলো কেটে দূরাবস্থার সৃষ্টি করছে দিনাজপুর জেলা পরিষদ।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আনোয়ার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন বলেন, জেলা পরিষদ থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে গাছগুলো কিনে নিয়ে কাটা হচ্ছে।

দিনাজপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী রইসউদ্দীন জানান, দিনাজপুর-সেতাবগঞ্জ সড়কে ৮টি বাজারে সড়ক সম্প্রসারণ হচ্ছে। সড়কটি প্রশস্ত ১৮ ফুট। আর বাজারগুলোয় প্রশস্ত করা হবে ২৪ ফুট। তাই ৮টি বাজারের সড়কের দুপাশে তিন ফুট করে ৬ ফুট প্রশস্ত করা হবে।

দিনাজপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোকলেসুর রহমান বলেন, আমি যোগদানের আগে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে একটি রিকুইজেশন এসেছিল। রাস্তার উন্নয়নে কাজ করা হবে, তাই এ গাছগুলো সরিয়ে দেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রিকুইজেশন মোতাবেক বন বিভাগ থেকে মূল্য সংগ্রহ, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবং বিভাগীয় কমিশনার অফিসে অনুমোদন করা হয়েছে। এরপর আমরা টেন্ডার দিয়েছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close