প্রিন্স রাসেল

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

স্পিনবিষে বাংলাওয়াশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ

টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা বাংলাদেশ পেয়েছে দেড় যুগেরও বেশি হবে। দীর্ঘ এই সময়ে অসংখ্য টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে টাইগাররা। বিব্রতকর এই হার এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উপহার দিলেন সাকিব-মিরাজরা। স্পিনারদের ঘূর্ণি জাদুতে স্রেফ নিঃশর্ত আত্মসর্পণ করল ক্যারিবীয়রা। গতকাল রোববার মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ইনিংস ও ১৮৪ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে এটাই টাইগারদের প্রথম ইনিংস ব্যবধানে জয়। ঐতিহাসিক এই জয়ে দুই ম্যাচের সিরিজে সফরকারীদের বাংলাওয়াশ করলেন সাকিব বাহিনী। কয়েক মাস আগে ক্যারিবীয় সফরে ধবলধোলাইয়ের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছিল বাংলাদেশ, ঘরের মাঠে সেটারই মধুর একটা প্রতিশোধ নিলেন সাকিব-মাহমুদউল্লাহ-মিরাজরা, সিরিজ জিতেছেন ২-০ ব্যবধানে। বাংলাদেশের একাদশই পরিষ্কার করে দিয়েছিল উইকেটের সম্ভাব্য চরিত্র। ঢাকা টেস্টের একাদশে নেই কোনো পেসার। কেন পেসারহীন দল নিয়ে বাংলাদেশ মাঠে নেমেছে সেটা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন সাকিবরা। তাদের স্পিনবিষে নীল হতে হলো ক্যারিবীয়দের। মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম, সাকিব আল হাসান, নাঈম হাসানের সামনে অসহায় একের পর এক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান ফিরে গেছেন সাজঘরে। প্রতিরোধ যা গড়েছেন কেবল শিমরন হেটমায়ার। স্পিন জোয়ারে ভেসে গেছে ক্যারিবীয়দের সেই বাঁধটাও। প্রথম ইনিংসে ১১১ রানে গুটিয়ে যাওয়া অতিথিদের ফিরতি ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট করেছে ২১৩ রানে।

প্রথম ইনিংসে সাত উইকেট তুলে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রায় একাই ধসিয়ে দিয়েছেন মিরাজ। ফিরতি ইনিংসেও ক্যারিবীয়দের যমদ্যূতরূপে হাজির হয়েছেন এই স্পিন জাদুকর। মিরাজের এক একটা ডেলিভারি যেভাবে সাপের মতো ফণা তুলেছে তাতে ব্রাথওয়েটদের দাঁড়িয়ে থাকার কোনো উপায় ছিল না। দুই ইনিংস মিলিয়ে মিরাজ শিকার করেছেন ১৪টি। প্রথম ইনিংসে সাতটি, পরেরবার আরো পাঁচটি। টেস্ট ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার অন্তত ১০ উইকেট নেওয়ায় অবধারিতভাবেই ম্যাচ সেরার স্বীকৃতিটা উঠে তার হাতে। তবে অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্সের সুবাদে সিরিজ সেরা হয়েছেন অধিনায়ক সাকিব।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস ও সাকিবের ব্যাটিং নৈপুণ্যের সুবাদে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে রানের পাহাড় গড়ে বাংলাদেশ। পরশু অলআউট হওয়ার আগে প্রথম ইনিংসে ৫০৮ রান করেছে টাইগাররা। জবাব দিতে নেমে শুরুতেই ধসে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং অর্ডার। মাত্র ২৯ রানের মধ্যে ক্যারিবীয়দের পাঁচ ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করেন সাকিব ও মিরাজ। দ্বিতীয় দিনের শেষ বিকেলে উইকেটের লাগাম টেনে ধরেন হেটমায়ার ও ডওরিচ। ষষ্ঠ উইকেটে ৪৬ রানের অবিচ্ছেদ্য জুটিতে কোনো রকম দিন পার করে সফরকারী দলটি।

তবু ফলোঅন চোখ রাঙাচ্ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ফলোঅন এড়ানোর চ্যালেঞ্জেই কাল তৃতীয় দিনের খেলা শুরু করেছিল ক্যারিবীয়রা। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আগেই সাত-সকালে ধসে পড়ে তারা। তৃতীয় দিন ৩৬ রান তুলতেই বাকি পাঁচ উইকেট খোয়ায় অতিথিরা। ৫৭ রানে ভাঙে ইনিংসের সবচেয়ে সফল জুটি। হেটমায়ার ৩৯ এবং ডওরিচ করেছেন ৩৭ রান। দুজনেরই ঘাতক মিরাজ। ইনিংসে আরো পাঁচজনকে সাজঘরের পথ দেখিয়েছেন তিনি। প্রথম ইনিংসে পতন হওয়া ক্যারিবীয়দের বাকি তিন উইকেটের মালিক সাকিব। বাংলাদেশ লিড পায় ৩৯৭ রানের। যা নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে টাইগারদের সর্বোচ্চ রানের লিড!

আরেকটু ছোট করে বললে লিড নিয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে ১৩৬ রান করেছেন এই অলরাউন্ডার। সেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১১ জন মিলে প্রথম ইনিংসে করেছেন ১১১ রান! মাহমুদউল্লাহর লিড ২৫ রানের। দ্বিতীয়বার ব্যাট করতে নেমে অবশ্য তাকে ছাড়িয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের ধারে কাছেও যেতে পারেনি তারা।

চট্টগ্রাম টেস্টে আড়াই দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। মিরপুরেও সেটার পুনরাবৃত্তি করতে প্রত্যাশিতভাবেই প্রথমবারের মতো কোনো দলকে ফলোঅন করায় টাইগাররা। এবারও ইনিংস শুরুরলগ্নে ক্যারিবীয়দের টুটি চেপে ধরেন স্বাগতিক স্পিনাররা। সেই ২৯ রানের মধ্যেই ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ শিবিরে। এবার পাঁচ নয়, ক্যারিবিয়ানদের উইকেট পড়েছে চারটি। তন্মধ্যে তাইজুলের শিকার দুটি। পরে তিনি নিয়েছেন আরো এক উইকেট। এই ইনিংসে সাকিবের শিকার মাত্র একটিই। পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে সফরকারীদের মিডল অর্ডার গুঁড়িয়ে দিয়েছেন মিরাজ।

দ্বিতীয় ইনিংসের উইকেটের স্রোত থামান হেটমায়ার। প্রতিরোধে এবার তার সঙ্গী শাই হোপ। পঞ্চম উইকেট জুটিতে লড়তে থাকেন তারা। জুটি ভাঙে ৫৬ রানে। ২৫ রানে হোপকে বিদায় করেছেন মিরাজ, ক্যাচ নিয়েছেন সাকিব। হোপের বিদায়ের পর নিয়মিত বিরতি দিয়ে উইকেট হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৩৭ রানে কেমার রোচ শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন। শেষ ব্যাটসম্যান শেরমন লুইস আউট হয়েছেন ২০ রানে। তবে ফিরতি ইনিংসেও ক্যারিবীয়দের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান হেটমায়ার। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিঃসঙ্গ লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। সতীর্থ ব্যাটসম্যানদের ভরাডুবির দিনে একাই যা আলো ছড়িয়েছেন ডেনজা হেটমায়ার।

হার নিশ্চিত জেনেই ওয়ানডে মেজাজে ব্যাট চালিয়েছেন। হারের ব্যবধান যতটা সম্ভব কমিয়ে আনাই লক্ষ্য ছিল তার। সতীর্থ ব্যাটসম্যানরা যখন অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন বাংলাদেশের স্পিনারদের কাছে, সেখানে মনের আনন্দে ব্যাটিং করেছেন হেটমায়ার। শেষ পর্যন্ত ৯২ বলে ৯৩ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেছেন তিনি। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে ইনিংসটা এই তরুণ সাজিয়েছেন ৯টি ছক্কায়! ইনিংসে চার মাত্র একটি! সেটাও শেষ দিকে। হেটমায়ারের ছক্কাগুলো ভালোই উপভোগ করেছেন দর্শকরা। একতরফা লড়াইয়ের দিনে বিনোদনটা ভালোই পেয়েছেন মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের উপস্থিত দর্শকরা!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close