মেহেদী হাসান

  ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

যাত্রী কল্যাণের মোজাম্মেল শূন্য থেকে কোটিপতি

তিনি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব। অথচ সংগঠনের নামে প্রভাব বিস্তার করে গোপনে নিজে গড়েছেন টাকার পাহাড়। কিনেছেন কোটি টাকার সম্পত্তি। রয়েছে পরিবহন ব্যবসা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির নামে লাইসেন্সবিহীন সিএনজি অটোরিকশার রমরমা ব্যবসা ছাড়াও সাংবাদিক পরিচয়ে করেছেন অঢেল সম্পত্তি। তিনি মোজাম্মেল হক চৌধুরী। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে অর্থ, সম্পদ ও ব্যবসার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। সেই সঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে গতকাল সোমবার আদালতে হয়েছে মামলা। জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মোজাম্মেল হক চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের ইমামুল্লাহ চরের পূর্ব পাড়ায়। বাড়িতে দুটি ঘর, এর মধ্যে বড় ঘরটির চারপাশে মাটির দেয়াল, ওপরে টিনের ছাউনি। সামনে ছোট দুই কক্ষের একটি ঘর। সেই ঘরের চারপাশে কাঠ দিয়ে দেওয়া হয়েছে বাঁশের বেড়া। স্বাভাবিক জীবনযাপন করা মোজাম্মেল গত এক যুগ ধরে পরিবহনের যাত্রীদের অধিকার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে সোচ্চার আছেন। যাত্রীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে করেন আন্দোলন। তবে এই যাত্রী কল্যাণ সমিতির আড়ালে গুছিয়েছেন নিজের আখের। বিভিন্ন দপ্তরে তদবির বাণিজ্য, সড়কে নিয়ম ভেঙে সুবিধা আদায়, বিআরটিএ’র মিরপুরসহ বিভিন্ন অফিসে দালালি, জমি কেনাবেচায় দালালি, নামসর্বস্ব পত্রিকায় সাংবাদিক পরিচয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন আদায়, লাইসেন্সবিহীন সিএনজি অটোরিকশার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব পরিচয়ে খাটান প্রভাব।

২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুর থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগে দায়ের হওয়া একটি মামলায় মোজাম্মেল গ্রেপ্তার হলে ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে তার স্ত্রী রিজু আক্তার চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ‘তার স্বামী (মোজাম্মেল হক চৌধুরী) একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে অল্প টাকা বেতনে কাজ করেন। সেই টাকা দিয়ে সংসার চালানো বেশ কষ্টকর।’

মাত্র ৬ মাসে কিনেন কোটি টাকার জমি : মোজাম্মেল হক চৌধুরীর গোপন সম্পত্তির অনুসন্ধান করে প্রতিদিনের সংবাদ। হাতে আসে বেশ কয়েকটি জমির দলিল। তাতে বেরিয়ে আসে কোটি টাকার সম্পত্তির তথ্য। দেখা যায়, মোজাম্মেলের অর্থের বেশিরভাগই ব্যয় হয়েছে জমি ক্রয়ে। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর মৌজায় দেড় কোটি টাকায় ৩৪৫ শতক জমি কিনেছেন মোজাম্মেল। দলিলে মৌজা অনুযায়ী, জমির যে দাম দেখানো হয়েছে প্রকৃতপক্ষে সেই জমির আনুমানিক মূল্য ৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরীর নামে রেজিস্ট্রি হওয়া জমির দলিলে দেখা গেছে, মোজাম্মেল চার দফায় ৪টি দলিলের মাধ্যমে হাশিমপুর মৌজায় বিভিন্ন দাগে ৩৪৫ শতক জমি কিনেন। রেজিস্ট্রি দলিলে ওই জমির মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা। তবে স্থানীয়দের দাবি, মোজাম্মেলের কেনা জমির প্রকৃত বাজারমূল্য তার কয়েকগুণ বেশি।

দলিলে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ২৩ জুন চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া সাব রেজিস্ট্রার অফিসে মোজাম্মেলের নামে প্রথম দলিলটি রেজিস্ট্রেশন (নম্বর ১৬৬২) করা হয়। ওই দলিলে ১ একর ৬০ শতাংশ (চার কানি) জমি কেনেন মোজাম্মেল। যার দাম দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ টাকা। এরপর একই বছরের ২৩ জুলাই ১৫ শতক জমির দ্বিতীয় দলিলটি রেজিস্ট্রি (দলিল নং ১৯০৮) করা হয় মোজাম্মেলের নামে। দলিলে জমির দাম উল্লেখ করা হয় ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

এর মাত্র এক মাসের মাথায় ১৬ সেপ্টেম্বর তৃতীয় দলিল রেজিস্ট্রেশন (নম্বর ২৪৪১) করা হয় তার নামে। জমির পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৫০ শতক। দলিলে এই জমির দাম দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। চতুর্থ দফায় ৮ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি জমি কিনেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী। রেজিস্ট্রেশন (নম্বর ২৫৩৮) হওয়া জমির পরিমাণ ১৩২ দশমিক ৫০ শতক। জমিটির দাম উল্লেখ করা হয়েছে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

মোট হিসাবে দেখা যায়, চার দফায় ৪টি দলিলে ৩৪৫ শতক জমি কিনেছেন মোজাম্মেল হক এবং দলিলে এই জমির মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা। অথচ আরো কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি রাখা হয়েছে গোপনে। ঢাকায় নিজেকে পরিচয় দেন ‘গোবেচারা’ হিসেবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, আগে মোজাম্মেলের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ২০০৯ সালের দিকে তৎকালীন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জাকারিয়ার পাওনা টাকা না দেওয়ায় মোজাম্মেলকে আটকে রেখেছিলেন। পরে টাকা পেতে স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়। তারপর থেকে মোজাম্মেলকে এলাকায় দেখা যেত না।

অটোরিকশা নিবন্ধন দালালিতে আয় কোটি টাকা

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামে রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্লেট ছাড়া প্রায় ২ শতাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলে ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সাংবাদিক সমিতি’র নামে। প্রতিটি গাড়িতে সাঁটানো হয়েছে সমিতির ব্যানার। ওই ব্যানারে ‘সাংবাদিক’ মোজাম্মেল হক চৌধুরীর নাম ও ফোন নম্বর রয়েছে। তবে তিনি কোন পত্রিকার বা অনলাইনের সাংবাদিক সে পরিচয় ব্যানারে উল্লেখ করা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্লেট ছাড়া সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলে মোজাম্মেলের ইশারায়। সেখান থেকে মাসিক চাঁদা আসে তার পকেটে। স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু মানুষের সহযোগিতায় রাজ্য গড়েছেন মোজাম্মেল। তার অপকর্মের বিরোধিতার জবাব হিসেবে কয়েকজনকে হুমকি দেওয়ারও তথ্য পাওয়া গেছে। ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সাংবাদিক সমিতি’র ব্যানারে সেখানেও রয়েছে তার প্রভাব। নিজে কোন পত্রিকার সাংবাদিক তা প্রকাশ না করলেও ওঠাণ্ডবসা মূলধারার সাংবাদিকদের সঙ্গে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে ‘সাংবাদিক ঘেঁষা’ হিসেবেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন মোজাম্মেল।

স্থানীয়রা বলছেন, মোজাম্মেল হক চৌধুরী অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। প্রভাবশালী মানুষদের সঙ্গে করেন ওঠাণ্ডবসা। নিজেকে পরিচয় দেন সাংবাদিক ও পরিবহন সমিতির নেতা হিসেবে। কোটি টাকার সম্পত্তির তথ্য গোপন রাখতেই সাধারণ জীবনযাপন করেন মোজাম্মেল। তবে পাল্টে গেছে তার কথার ধরন।

জানা যায়, টাকার বিনিময়ে মোজাম্মেল সিএনজি অটোরিকশার নম্বর পাইয়ে দেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রভাব খাটিয়ে বিআরটিএতে দালালি করেই তিনি এত টাকার মালিক হয়েছেন। আর সেই টাকায় কিনেছেন কোটি টাকার সম্পত্তি। মোজাম্মেল হক বর্তমানে জমি বেচাকেনা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঢাকাতে রয়েছে একটি প্রাইভেট কার যার আনুমানিক মূল্য ১২-১৫ লাখ, একটি নোহা গাড়ি যার আনুমানিক মূল্য ২৫ লাখ ও চট্টগ্রামে একটি অত্যাধুনিক প্রাইভেট কার রয়েছে যার আনুমানিক দাম প্রায় অর্ধকোটি টাকার কাছাকাছি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মোজাম্মেলের স্ত্রী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার পদে প্রার্থী হয়ে ৩০ ভোট পেয়েছিলেন। মোজাম্মেল নিজেও উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে খুব অল্প ভোট পেয়েছিলেন। তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

সেতুমন্ত্রীকে নিয়ে মন্তব্য, থানায় জিডি ও মামলা

সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে মানহানিকর মন্তব্য করার অভিযোগে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন। গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) ঢাকার শাহবাগ থানায় জিডি করেন তিনি।

জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২০ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ২০ বছর ধরে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তিনি পরিবহন সেক্টরে কোনো কাজ করেন নাই। যেহেতু আমাদের দেশে পদত্যাগের সংস্কৃতি নেই। সেহেতু মন্ত্রী ইচ্ছা করলে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করতে পারেন।’

জিডিতে শ্রমিক লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি যাত্রীদের কল্যাণ করবে এটাই তাদের কাজ। কিন্তু সুপরিকল্পিতভাবে মোজাম্মেল হক চৌধুরী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এতে মন্ত্রীর সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কারণ বর্তমান সরকার টানা চতুর্থবারের মতো দেশের ক্ষমতায় আছেন। এখন সরকারের ক্ষমতা থাকার বয়স ১৫ বছর ৩ মাস। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী সেখানে ২০ বছর মন্ত্রী থাকেন কীভাবে? মোজাম্মেল হক চৌধুরী সুপরিকল্পিতভাবে মন্ত্রী ও সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন। এই মিথ্যাচারের বক্তব্যগুলো দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। তার এই মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্যে সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ণ ও মন্ত্রীর মানহানি হয়েছে। তাই বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য জিডি করে রাখা একান্ত প্রয়োজন।’

জানা গেছে, মোজাম্মেল হক চৌধুরী সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রকে নিয়ে মন্তব্য করায় জিডির পরে সিএমএ আদালতে মামলা করেছেন মোহাম্মদ হানিফ খোকন। ৫৫১ নাম্বার মামলায় ৫০০, ৫০১ ও ৫০৬ তিনটি ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন মোহাম্মদ হানিফ খোকন। মামলার তদন্তে নেমেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি জমির দালালি করি। ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেই টাকায় জমি কিনেছি। দেশের কোন আইনে জমি কিনতে মানা আছে নাকি?’

মাত্র ৬ মাসে কোটি টাকার জমির মালিক বনে যাওয়ার বিষয়ে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। কাল প্রেস ক্লাবে আসেন। আমার কেনা জমিগুলো আমার; এ কথা ঠিক। কিন্তু জমিগুলো চিনি না। শুধু কাগজ কিনেছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close