নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে শিশুরা স্কুল বন্ধের পক্ষে অভিভাবকরা

রেকর্ড তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়, হাসপাতালে শিশু রোগী বাড়ছে

দেশজুড়ে চলছে তাপপ্রবাহ। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। দীর্ঘ ছুটি শেষে গত রবিবার প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যায়ের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরু হয়। পাঠদানের প্রথম দিন রবিবার অনেক শিক্ষার্থী গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

এদিন রাতে আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে শিক্ষা মন্ত্রলণালয় ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। অভিভাবকরাও পাঠদান শুরু হওয়ায় শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তারাও চান চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে স্কুলে পাঠদান বন্ধ থাকুক। তবে অনলাইনে ক্লাসের পক্ষে মত দিয়েছে তারা। গত রবিবার রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।

এদিকে নোয়াখালীর হাতিয়া ও বেগমগঞ্জ উপজেলার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচণ্ড গরমে ১৮ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে বিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষকরা স্থানীয় পল্লিচিকিৎসক ডেকে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। রবিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে বেগমগঞ্জের আমান উল্লাপুর ইউনিয়নের জয়নারায়ণপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা ও হাতিয়া উপজেলার জনকল্যাণ শিক্ষা ট্রাস্ট হাইস্কুলে এ ঘটনা ঘটে। এদিন মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী ও শ্রীনগরে বিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালে শ্রেণিকক্ষে দুই শিক্ষার্থী, ফরিদপুরের সালথায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩ শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় এক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকার বিভিন্ন স্কুলেও শিক্ষার্থীদের গরমে হাঁসফাঁস করতে দেখা গেছে। প্রচণ্ড গরমে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে।

চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু ও বয়স্ক নাগরিকরা বলে জানান ইমিরেটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, যেকোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। সেটা শারীরিক মানসিক কিংবা অন্য যেকোনো বিষয়ে। তাপপ্রবাহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, এ গরমের মধ্যে শিশুদের বাইরে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুরা যখন স্কুলে যাবে তখন তারা রোদের মধ্যে খেলাধুলা করবে, বাইরের খাবার খাবে, যা তাদের স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। গরম থেকে বাঁচতে এ সময় শিশুরা আইসক্রিম ও কোমল পানীয় বেশি খাবে যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য নেতিবাচক। যেহেতু চলমান তাপপ্রবাহ খুব বেশি দিন থাকবে না, তাই এ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাই ভালো।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, আমার সঙ্গে অনেক অভিভাবকের কথা হয়েছে। এ তাপপ্রবাহে তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। আমার মনে হয় সরকার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারে। আমাদের দেশের স্কুলগুলোয় এসি নেই, আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্যানও নষ্ট থাকে; ফলে এ গরমে ক্লাস করা শিশুদের জন্য কঠিন। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে খবর দেখলাম এ সময়ে দুজন শিক্ষক গরমের কারণে মারা গেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে তা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত করে তুলতে পারে। যেহেতু গরম বেশিদিন থাকবে না তাই শিশু ও তাদের অভিভাবকদের কথা বিবেচনায় নিয়ে এ সপ্তাহটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক বলেন, তাপমাত্রা যখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেমে আসবে তখন আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে রাখতে পারি। ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রয়োজনে আমরা স্কুলের সময় বাড়িয়ে দিতে পারি। প্রয়োজনে কয়েকটি সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে দিয়ে ক্লাস নিতে পারি। তাপপ্রবাহে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশসেরা এ চিকিৎসক। তিনি বলেন, স্কুল বন্ধ রাখলেন, আবার একই সময়ে অভিভাবকরা শিশুদের কোচিংয়ে পাঠিয়ে দিলেন তাহলে তো কোনো লাভ হলো না। গ্রামে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা সারাদিন মাঠে খেলতে বের হয়ে যায়, এটা তাদের আরো ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। অভিভাবকরাও চান চলমান তাপপ্রবাহে স্কুল-কলেজে পাঠদান বন্ধ থাকুক।

গরমের দাপট, রেকর্ড তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় : ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে এখনো তাপপ্রবাহ চলছে। প্রচণ্ড গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আজ মঙ্গলবার ও আগামীকাল বুধবারও গরমের এ দাপট থাকতে পারে। ২ মে থেকে ঢাকাসহ ৪ বিভাগে বৃষ্টি হতে পারে। ওই সময় তাপপ্রবাহ কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গায় গতকাল সোমবার দুপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এটিই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। গত রবিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের মোংলা, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, খুলনা, পাবনার ঈশ্বরদী, নওগাঁর বদলগাছী, নীলফামারীর সৈয়দপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি ও এর ওপরে। এছাড়া দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। তবে সিলেটে ১৬ মিলিমিটার ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

প্রচণ্ড গরমের কারণে সারা দেশে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দুপুরের আগেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে কুষ্টিয়া শহরের সড়কগুলো। এদিকে ঢাকাসহ দেশের কোথাও কোথাও বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)। আগামী ২ মে থেকে চারটি বিভাগসহ বেশকিছু জায়গায় বৃষ্টির আভাস পাওয়া গেছে। আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল কালাম মল্লিক জানান, ২ মে থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ বিভাগসহ ঢাকা বিভাগসহ দেশের কিছু কিছু জায়গায় বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে তাপমাত্রা কমবে।

হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে : গরমের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জ্বর ও সর্দিজনিত রোগী। আক্রান্তদের অধিকাংশই শিশু। ২৫০ শয্যা চাঁদপুর সরকারি জেনারেল (সদর) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ধারণক্ষমতার চারগুণ রোগী ভর্তি। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের। রবিবার দুপুরে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে দেখা গেছে, জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, টাইফয়েডসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে আউটডোরে টিকিট কাউন্টারের সামনে নারী-পুরুষরা ভিড় করছেন। হাসপাতালের পুরুষ, শিশু ও নারী ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় হাসপাতালের করিডোর ও বারান্দার মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। গরমে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে শিশু রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

জেলা শহরের নিউ ট্রাক রোড থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সবুজ তালুকদার বলেন, আমার বাচ্চার প্রচণ্ড জ্বর। হাসপাতালে এসে সিট পাইনি। প্রচণ্ড জ্বরের মধ্যে দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে রাত কাটানোর কারণে আরো বেড়েছে। সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে বাচ্চা আরো অসুস্থ হয়ে গেছে। চাঁদপুর সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নের মাসুম বিল্লাহ বলেন, এক বছরের শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন গত চার দিন ধরে। গরমের কারণে মেয়ের ঠাণ্ডা ও নিউমোনিয়ার চিকিৎসা চলছে। তবে শিশু ওয়ার্ডে অনেক রোগী, যার কারণে সেখানে বেড না পেয়ে বারান্দায় থাকতে হচ্ছে। চাঁদপুর সদর হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আসমা বেগম বলেন, প্রচণ্ড গরমের কারণে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত শিশু ভর্তি হওয়ার কারণে আমাদেরও চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ কে এম মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের ২৫০ শয্যার বিপরীতে হাসপাতালে রোগী ভর্তি আছে চার শতাধিক। এর মধ্যে শিশু ওয়ার্ডে ৪২ বেডের বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ১৬৫ জন। আমাদের চিকিৎসক ও নার্সরা সেবা দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না যাওয়াই ভালো। সবাই ছায়াযুক্ত স্থানে থাকবেন এবং বেশি বেশি পানি পান করবেন। বিশেষ করে অভিভাবকদের শিশুদের প্রতি আলাদা নজরদারি ও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close