ইফতেখার আহমেদ টিপু
দাবি
কর্ণফুলীকে বাঁচতে দিন
লুসাই পাহাড় থেকে আসা কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রামের পরিচিতির অনুষঙ্গ হিসেবেই বিবেচিত। দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রাণভোমরা চট্টগ্রাম বন্দরেরও প্রাণ বলে অভিহিত করা হয় এই নদীকে। প্রাণবন্ত এই নদী এখন দখল ও দূষণের নির্মম শিকার। চট্টগ্রামবাসীর প্রিয় নদীর উভয় পারে গড়ে উঠেছে ২ হাজার ১৮১টি স্থাপনা। এসব স্থাপনা কর্ণফুলীর অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানছে। দখল-দূষণে বিপন্ন হয়ে পড়ছে নদী। গত বছরের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ৯০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয়। কিন্তু আদালতের হুকুম তামিল না হওয়ায় কর্ণফুলীকে দখল-দূষণ থেকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জেলা প্রশাসন অর্থাভাবের কারণ দেখিয়ে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছে। তাদের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযানের জন্য অর্থ বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে। ১ কোটি ২০ লাখ টাকার সে বরাদ্দ না পাওয়ায় উচ্ছেদ অভিযান অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
স্মর্তব্য, ২০১০ সালে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে কর্ণফুলী নদী রক্ষায় জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এতে কর্ণফুলী নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে সীমানা নির্ধারণ, দখল, ভরাট ও নদীতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১০ সালের ১৮ জুলাই কর্ণফুলী নদীর সীমানা চিহ্নিত করার জন্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও ভূমি জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশনা দেন। ২০১৫ সালে দখলদারদের তালিকা চূড়ান্ত করে আদালতে জমা দেওয়া হয়। এরই আলোকে গত বছরের ১৬ আগস্ট অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে নৌবাহিনী ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদের বাইরে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। অর্থাভাবে কর্ণফুলীর দুই পার থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ বাস্তবায়িত না হওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। মূলত তাদের ক্ষমতার দাপট আদালতের রায় মান্য করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিপদাপন্ন কর্ণফুলীর অস্তিত্ব রক্ষায় ক্ষমতাবানদের এ দাপট থামাতে হবে।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, কর্ণফুলী নদীর দুই পারে বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত প্রায় সাড়ে ৭০০ থেকে ১ হাজার শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্যে কর্ণফুলী এখন মূলত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কাগজকল, রং কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার-কারখানা, ট্যানারি, তেল-কারখানা, সাবান ফ্যাক্টরি, রেওন মিল, রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন কেন্দ্র এবং টেক্সটাইল মিল থেকে নির্গত বর্জ্য প্রতিনিয়ত দূষণ করছে দেশের অন্যতম প্রধান এ নদীকে। এ ধরনের ১৫০টি কারখানা থেকে ৬২ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ কর্ণফুলীর পানির সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করছে বলে আশঙ্কাজনক তথ্য দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।
পরিবেশবিদদের মতে, স্বাভাবিক পানিতে যে পরিমাণ দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা এখানে তা অনেক ক্ষেত্রেই কমে গেছে। অক্সিজেনের অভাবে পানিতে জলজ প্রাণী বাস করতে পারছে না। সাধারণ পানির ক্লোরাইডের মাত্রা লিটারপ্রতি ১৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম থাকার কথা থাকলেও কর্ণফুলীতে আছে অনেক বেশি। পানির দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের মাত্রা যেখানে প্রতি লিটারে ১০০ মিলি গ্রাম হওয়ার কথা, সেখানে কর্ণফুলীর পানিতে রয়েছে ২৪৩ মিলি গ্রাম। কর্ণফুলী নদীর দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত পানি কাপ্তাই ও রাঙ্গুনিয়া এলাকার শত শত একর জমিতে কৃষকরা চাষাবাদ করছেন। ফলে রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত পানির কারণে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। এতে ফসলের উৎপাদন কমে এসেছে বলে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে নদীর দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে হাজার হাজার মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন।
পরিবেশ অধিদফতরের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, কণর্ফুলী দূষণের সবচেয়ে বড় দায় চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কর্ণফুলী পেপার মিলের। এখান থেকে নদীতে প্রতিনিয়ত অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলী নদীর পানিতে ফেলে দেওয়ার কারণে দূষণে নদীর ৩৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পরিবেশ অধিদফতরের অনুসন্ধান অনুযায়ী একসময়ে কর্ণফুলী নদীতে ৬৬ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ৫৯ প্রজাতির মিশ্র পানির এবং ১৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যেত। এখন মিঠা পানির ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির এবং মিশ্র পানির ১০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত প্রায়। এ ছাড়া আরো ২০ প্রজাতির মাছ হুমকিতে রয়েছে। কর্ণফুলী নদী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছের মধ্যে রয়েছে ফাইস্যা, কাঁচকি, রূপচাঁদা, কালিচাঁদা, পাঙাশ, বাচা, ভেটকি, পাশা, লইট্যা, রিকশা, মধু, পাবদা, পোয়া, মহাশোল ইত্যাদি। এ ছাড়া কাতলা, রুই, মৃগেল মাছও কমতে শুরু করেছে।
দূষণ প্রতিরোধের পরিশোধনাগার (ইটিপি) বসানোর আইন থাকলে ও কেউ তা মানছে না। গত কয়েক বছরে নদীর ওপাড়ে অবস্থিত জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রেলওয়ের ট্যাংকারে করে তেল পরিবহনের সময় তা দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি তেল কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। অপরদিকে কিছু দিন আগেই কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে ডিএপি-১ (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) সার কারখানার অ্যামেনিয়া ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয়ে অনেক তরল অ্যামোনিয়া কর্ণফুলী নদীর পানিতে মিশে পানি দূষিত করেছে। সিটি কর্পোরেশন এলাকার প্রায় ৫০ লাখ জনসংখ্যার বর্জ্য বর্ষাকালে ধুয়ে এ নদীর পানিতে মিশে। এ ছাড়াও নদীর দুই পাড়ের জনবসতি থেকে প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য কর্ণফুলীতে যোগ হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ছোট-বড় নৌযান থেকে নির্গত তেল পানিতে মিশে নদীকে দূষিত করছে। যা মাছ ও জলজ উদ্ভিদের প্রজনন ও জীবনধারণের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সরকার এই নদীকে দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হলে এই দখলদারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে বিষাক্ত পরিবেশ। যা গোটা চট্টলাকে ধ্বংস করতে সময় নেবে মাত্র কয়েকটা বছর। যা কখনোই কোনো বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না। আমরা বিবেকবান মানুষ হয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
লেখক : চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
"