রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২২ জুলাই, ২০১৭

আন্তর্জাতিক

নতুন যুদ্ধের আশঙ্কায় মধ্যপ্রাচ্য

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বর্তমানে কাতার ইস্যু সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সৌদি আরব এবং বেশ কয়েকটি দেশ কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ শুরু হয়েছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কলকাঠি নাড়ছেন, অন্যদিকে রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কাতারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সব মিলিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে বিশ্ব পুনরায় নতুন মেরুকরণে ব্যস্ত। এদিকে চরমপন্থার সঙ্গে কথিত যোগসাজশের যে অভিযোগ কাতারের বিরুদ্ধে উঠেছে, তা থেকে মুক্তি পেতে নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতিকে বাদ দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করা হবে না বলে দেশটি ঘোষণা করেছে। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল-থানি বলেছেন, সংকট সমাধানে তিনি কূটনৈতিক সমাধান চান।

মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের চেয়ে ছোট দেশ আর নেই। কিন্তু তার ঐশ্বর্য রয়েছে প্রচুর। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জামাল উদ্দীন আফগানি নামে এক মনীষী মুসলমানদের দুর্দশা দেখে প্যান ইসলামিক আন্দোলন নামে এক আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন মুসলিম জগতের দুর্দশা লাঘবের জন্য মুসলিম বিশ্বের সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন। তিনি তার আন্দোলনের বার্তা নিয়ে মুসলিম বিশ্ব সফরও করেছিলেন। কিন্তু তখন জামালউদ্দীন আফগানি সফল হননি। তবে কোনো মহতী প্রয়াস ব্যর্থ হয় না। একবিংশ শতাব্দীতে এসে মুসলিম বিশ্বকে যখন বিধ্বস্ত করে ফেলার এক গভীর ষড়যন্ত্রে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইহুদিবাদীরা মেতে ওঠে তখন মুসলিম নেতাদের মাঝে জামালউদ্দীন আফগানির সেই প্যান ইসলামিজমের চেতনা জাগ্রত হয়। সে সময়কার নেতাদের মাঝে কাতারের সাবেক আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি অন্যতম। তিনি বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পিতা। তিনি ব্রিটেনের স্যান্ডহার্ট মিলিটারি একাডেমির গ্র্যাজুয়েট। সৌদি এবং থানিরা একই বংশের লোক। বনু তামিম গোত্রের দুই ধারা সৌদ আর থানি। সৌদিরা ছিল নজদের সর্দার এখন সৌদি আরবের রাজা আর থানিরা ছিল কাতারের সর্দার এখন কাতারের আমির।

আফগানিস্তানে খনিজ অনুসন্ধানের দিকে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ খনিজ অনুসন্ধানকারীদের মতে, আফগানিস্তানে বিশ্বের বৃহত্তম তামা মজুদ রয়েছে। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইহুদি মায়ের সন্তান জেনারেল সিসিরের ক্ষমতা গ্রহণকে কাতার মেনে নেয়নি, বরং জেনারেল সিসির অত্যাচারে দেশত্যাগ করা ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীদের আশ্রয় দিয়েছে কাতার। মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসি এবং ব্রাদারহুড হচ্ছে প্যান ইসলামিজমে বিশ্বাসী। ইরান ও তুরস্ক ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা সমর্থন করেনি। উভয় সরকার জেনারেল সিসির কর্মকা-ের তীব্র সমালোচনা করে। আরব বসন্তের পরে নির্বাচনে জিতে ড. মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হন। প্যান ইসলামিজমে বিশ্বাসী কাতার, ইরান, তুরস্ক ও মিসরের মাঝে তখন একটা ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণের সৎ ইচ্ছার প্রকাশ পায়। এক ইহুদি যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যখন গাজায় ফিলিস্তিনিদের ঘেরাও করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চলে তখন মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসি ইসরাইল সীমান্তে মিসরীয় সৈন্য সমাবেশের নির্দেশ দেন। মুরসি গাজার সঙ্গে মিসরের এমন সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন যেন গাজায় মিসর থেকে খাদ্য পৌঁছতে পারে, তুরস্ক জাহাজে করে গাজায় খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়েছে। কাতারও তখন অকাতরে সাহায্য পাঠিয়েছিল। মিসর, কাতার, তুরস্কের প্রচেষ্টায় তখন গাজার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের চুক্তি হয়। সেই চুক্তি সম্পাদনের সময় আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও শেষ পর্যায়ে এসে যোগদান করেন।

সেই থেকে তুরস্ক, ইরান, মিসর ও কাতারের মাঝে ঐক্যবদ্ধ কর্মকা-ের প্রয়াস দেখে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরাইল হুঁশিয়ার হয়ে ওঠে। প্রথম প্রচেষ্টায় তারা মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেলে বন্দি করে রাখে। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তুরস্কের গণমানুষের ব্যাপক প্রতিরোধের মাঝে অভ্যুত্থান নিষ্ফল হয়ে যায়। এখন সর্বশেষ উদ্যোগ নিয়েছে কাতারকে বিধ্বস্ত করে দেওয়ার। গত ৫ জুন সৌদি আরব, মিসর, আরব আমিরাত এবং বাহারাইন কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে কাতারকে একঘরে করে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। কাতারের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, কাতার সন্ত্রাসী লালন করছে এবং সন্ত্রাসীদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। সৌদির এ উদ্যোগে কুয়েত ও ওমান যোগদান করেনি। বরং কুয়েতের আমির রিয়াদ গিয়েছিলেন সমঝোতার উদ্যোগ নিয়ে।

এদিকে সৌদি আরব, ইরান ও রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল উৎপাদন করে। তেলই এই মুহূর্তে বৈশ্বিক সম্পর্ক নির্ধারণ করছে। চীন বিশ্বে নিজের প্রভাব বাড়ানোর জন্য উচ্চাকাক্সক্ষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য চীনের এ বিস্তার লাভের জন্য উপযুক্ত এলাকা। যদি চীন সফল হয়, তবে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিতে পারবে চীন।

এত দিন মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে আসছিল ইউরোপ, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। নতুনভাবে এখানে যুক্ত হতে যাচ্ছে চীন। মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায় চীন। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়াতে কোনো বাধা সৃষ্টির পরিকল্পনা নেই চীনের। এ কথা সবারই জানা যে, ইসরায়েলের পর সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তিক্ত সম্পর্ক। চীনের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো ছিল আগেই। এখন নতুন করে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চায় চীন। সৌদি আরবের এ সম্পর্ক উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য তেহরানের বিরুদ্ধে নিজেদের মিত্র বাড়ানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে রিয়াদের প্রভাব বাড়ানো। চীনের উদ্দেশ্য মধ্যস্থতাকারী হওয়া নয়। বরং সৌদি আরবের অন্য মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এখানে অন্যতম কারণ। চীনের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে কি না তা অনেক বিশেষজ্ঞের কাছে প্রশ্ন। তবে এখানে অনেক বিষয় জড়িত আছে। স্বার্থ জড়িয়ে আছে। অন্য পরমাণু শক্তিধর দেশ যেমন-রাশিয়াও রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন এক অক্ষ তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীর ভূমিরূপের মতো রাজনীতিরও টেকটোনিক প্লেট পরিবর্তিত হচ্ছে।

সৌদি জোট কুয়েতের মাধ্যমে অনেকগুলো দাবি পেশ করেছে কাতারের কাছে। কাতার তাদের দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। যেমন-ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বের করে দেওয়া এবং দুই দেশের সামরিক সহযোগিতা ছিন্ন করা, তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা এবং সামরিক সহযোগিতার সমাপ্তি ঘোষণা করা, সন্ত্রাসী সংগঠন হামাস, মুসলিম ব্রাদারহুড, হিজবুল্লাহ, আল কায়েদা ও আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, সৌদি জোট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করছে তাদের আর্থিক সাহায্য প্রদান বন্ধ করা। সৌদি আরব, মিসর, বাহরাইন ও আমিরাত যেসব ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করেছে তাদের স্থানান্তর করা, আলজাজিরা চ্যানেল এবং চ্যানেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া, সৌদি আরবসহ উপ-সাগরীয় চার দেশ ও মিসরের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করা এবং গত কয়েক বছরে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। সৌদি আরবের সঙ্গে ২০১৪ সালে যে চুক্তি হয়েছিল তার আলোকে সৌদি আরবসহ উপ-সাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিসর ও বাহরাইনের ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করা, কাতারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত সব সংবাদমাধ্যম বন্ধ ঘোষণা করা। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব টিলারসন বলেছেন, এ দাবিগুলোর একটিও মানার মতো নয়। এ দাবিগুলো দাসত্বমূলক দাবি। শেষ পর্যন্ত এ দাবির একটিও মানবে বলে মনে হয় না কাতার। এখন মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হবে। কাতার, ইরান, তুরস্ক এখন অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি কাতারের আমিরকে অব্যাহত সমর্থন প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন। হামাসের শক্তিশালী গেরিলাদের সমর্থনও রয়েছে কাতারের প্রতি। সৌদি আরবের পক্ষে মিসর ভিন্ন সামরিক শক্তিসম্পন্ন কোনো রাষ্ট্র নেই। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র কখনো কারো ভালো বন্ধু হতে পারেনি। আর সে কারণেই সৌদিআরবকে অন্যের কথায় নতুন করে যুদ্ধে জড়ানোর ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে। কেননা এ যুদ্ধে কারো কোনো ক্ষতি না হলেও সৌদিআরবের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাটা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist