ফয়জুন্নেসা মণি
নজরুল জন্মজয়ন্তী
দ্রোহ-বিদ্রোহের প্রেমিক
অসচ্ছল এক মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন এক বিদ্রোহী। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দুঃখ-দুর্দশা, অভাব দমাতে পারেনি তাকে। দ্রোহের আগুনের মতো অভাবের আগুনে পুড়ে মহাবিদ্রোহীর খেতাব নিয়েছেন আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামের দুখু মিয়া। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ-দুই বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমাদৃত। কবি নজরুলের বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়। বিদ্রোহী খেতাবের পেছনের কারণ হলো—নজরুলের কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার, সামাজিক অনাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। কবির পিতা ফকির আহমেদের তিন ছেলে আর এক মেয়ে। প্রথম সন্তানের জন্মের পরপর চারটি সন্তানের মৃত্যু হয়। এরপর বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বা ১৮৯৯ সালের ২৫ মে এই দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে একটি ফুটফুটে ছেলে। তার নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। সেই দুখু মিয়া একসময় আপন কর্মগুণে কবি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি শুধু আমাদের জাতীয় কবিই নন—অবিচার, অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি স্বনামে মহিমান্বিত দুর্বার প্রতিবাদের এক অসাধারণ প্রতীক পুরুষ। তার মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। দুখু মিয়ার জীবনের সঙ্গে দুঃখ যেন পরম সাথী। হোটেলে কাজ করে পড়ার খরচ চালাতেন তিনি। তার প্রাথমিক শিক্ষা ধর্মীয়। একপর্যায়ে তিনি স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বিভিন্ন গানের দলের সঙ্গেও কাজ করতেন। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে সম্পৃক্ত থাকলেও বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় তার দখল ছিল।
কবি নজরুল ইসলাম আজীবন সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। কবির জীবনসংগ্রাম আমাদের প্রেরণার পথ দেখায়, হতাশার মাঝে আশার আলো জ্বালে। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি, ধর্মীয় ও লিঙ্গবৈষম্য এবং বিদ্রোহ। বাংলা কাব্যে তিনি ইসলামী সংগীত তথা গজলকে সংযুক্ত করে এক নতুন ধারার জন্ম দেন। পাশাপাশি তিনি শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। কবি নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশের সুরারোপ করেছেন-যেগুলো এখন নজরুল সংগীত বা ‘নজরুলগীতি’ নামে পরিচিত। সৃষ্টির সম্ভারেও কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে অবশ্য পাঠ্য এবং অনন্ত গবেষণার উৎস হয়ে থাকবেন। মহান এই কবি জীবনের পরতে পরতে নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে নিজেকে খাপখাইয়ে যেকোনো পরিস্থিতিকে জয় করেছেন-যা যুগ যুগান্তরে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। জীবন চলার পথে যেকোনো দুর্যোগ, পরিস্থিতি কিংবা প্রতিকূলতা মোকাবিলায় অদম্য প্রেরণার চিরন্তন নজির স্থাপন করে গেছেন কবি নজরুল ইসলাম। কবি নজরুল বিপ্লবী কবি, দ্রোহ-বিদ্রোহের কবি, সাম্য-শান্তির কবি, গীতি-আরাধনার কবি আবার তিনি প্রেম-পূজারি কবিও বটে। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অনবদ্য কবিতা বিদ্রোহী এবং ভাঙার গান আজও চেতনায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উৎসারণ ঘটায়। সাহিত্যের জগতে কবি নজরুলের মতো উজ্জ্বল নক্ষত্র আর দ্বিতীয়টি নেই।
তার জীবনটা খুবই বৈচিত্র্যময়। নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তিনি যেন হয়ে উঠেছেন গণমানুষের কবি। যৌবনে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে করাচি সেনানিবাসে বসে বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প : হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি রচনা করেন। নিয়মের ছকে বাঁধা জীবন-যাপন তাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই তিনি চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন সাংবাদিকতায়। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এ সময় বিদ্রোহী এবং ভাঙ্গার গান কবিতা লিখে কবি জেলও খেটেছেন। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অনবদ্য কবিতা বিদ্রোহী এবং ভাঙার গান আজও চেতনায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উৎসারণ ঘটায়। কবি হিসেবে তার সুখ্যাতি থাকলেও ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন মজার মজার ছড়া। খুকি ও কাঠবিড়ালী, লিচুচোর, পিলে-পটকার মতো মজার মজার ছড়া খুব কম সংখ্যক কবিই লিখতে পেরেছেন। ছড়া-কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন গান ও ইসলামী সংগীত বা গজল। অসম্ভব সুরেলা কবি নজরুলের গজল। তিনি অভিনয়ও করেছেন। গীতিকার, সুরকার, সাংবাদিক, সৈনিক, রাজনীতিবিদ এমনকি দার্শনিক হিসেবেও বিস্ময়কর বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।
অভাব, দুঃখ, বঞ্চনা, ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত নজরুলের কবি সত্তায় বারবার উঠে এসেছে অন্যায়ের প্রতিবাদ, বৈষম্য, দুঃশাসন আর শোষণের প্রতিবাদ। তার লেখায় বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশের কারণে তাকে বিদ্রোহী কবির খেতাব দেওয়া হয়েছে। খেয়ালী এই কবি সৈনিকের পোশাক পরে বিভিন্ন সভায় এসে হাজির হতেন। বড়ই বৈচিত্র্যময় তার জীবন। কৈশোরে তিনি লেটোর দলে গান গেয়েছেন। যাত্রাপালায় অভিনয় করেছেন। যুদ্ধ করেছেন। মানুষ ও মনুষ্যত্ববোধকে তিনি জাগরিত করেছেন। কিশোর নজরুল এসেছিলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে। সেখানে দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সপ্তম শ্রেণির পাঠ শেষ করে আবারও বর্ধমানে চলে যান। তিনি বিয়ে করেছেন কুমিল্লায়।
নজরুলের কবিতা ও গান তরুণদের হৃদয়ে জাগরণের সৃষ্টি করে। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম...’, ‘কারার ঐ লোহ কপাট’-এমন সব গানের কথায় রক্তে শিহরণ জাগে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এসব গান ও কবিতা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এ সময়
তাকে জাতীয় কবির সম্মানেও ভূষিত করা হয়। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্...ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ কবিতাকে বাংলাদেশের জাতীয় রণসংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে ২৯ আগস্ট বিস্ময়কর প্রতিভাধর এই কবি বাংলাদেশেই মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
পিডিএসও/হেলাল