ফয়জুন্নেসা মণি
স্কুল ব্যাংকিং
প্রজন্মের ভবিষ্যৎ
শিক্ষার্থীদের মাঝে সঞ্চয় প্রবণতা সৃষ্টিতে একটি আশা জাগানিয়া উদ্যোগের নাম স্কুল ব্যাংকিং। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিয়ার রহমানের এই সৃজনশীল উদ্ভাবনী উদ্যোগ প্রশংসনীয় তো বটেই, জাতীয় অর্থনীতি মেরূকরণের নতুন দিগন্তও বটে। বাংলাদেশে স্কুল ব্যাংকিং চালু হয়েছে ছয় বছরের কিছু বেশি সময়। মাত্র ছয় বছরে দেশের ব্যাংকগুলোয় ছাত্রছাত্রীদের ব্যাংক হিসাব ১২ লাখের বেশি হওয়া কম কথা নয়। তার চেয়েও আনন্দের সংবাদ, হিসাবগুলোয় জমাকৃত টাকার পরিমাণ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এই সঞ্চয় নতুনমাত্রা যোগ করেছে। এ সঞ্চয় একদিকে শিশু-কিশোরদের মানসপটে ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তার স্বপ্নবীজ বপন করে দিয়েছে, অন্যদিকে সন্তানের সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য বাবা-মায়ের মাঝেও সঞ্চয়কামী মানসিকতা জাগিয়ে তুলেছে। তার চেয়েও বড় বিষয়টি হলো আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এই সঞ্চয় নতুন নতুন বিনিয়োগ খাত সৃষ্টি করবে।
বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীদের সঞ্চয়মুখী করে গড়ে তুলতে ২০১০ সালে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রম চালুর নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকেই স্কুলপড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় মুনাফার নানা স্কিম চালু করে। ২০১১ সাল থেকে হিসাব খোলা শুরু হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় দেশের ব্যাংকগুলোয় মোট ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭টি হিসাব খোলা হয়। ওই সময় হিসাবগুলোয় মোট স্থিতি ছিল ৯৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের মার্চে স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় খোলা হিসাবগুলোয় জমার পরিমাণ ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ব্যাংকে ১২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৭০টি হিসাব খুলেছে। এই হিসাবগুলোয় জমা রয়েছে এক হাজার ২০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। একটি হিসাবের বিপরীতে গড় জমা রয়েছে ৮ হাজার ১১৮ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যত ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে শহরের শিক্ষার্থীরা ৭ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৪টি এবং গ্রামের শিক্ষার্থীরা ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৬টি হিসাব খুলেছে। এই অগ্রগতি আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
স্কুল ব্যাংকিং সুবিধায় ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ী হয়ে উঠছে দেশের স্কুলপড়–য়া শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিনই বাড়ছে স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় খোলা হিসাব সংখ্যা ও সঞ্চয় স্থিতি। ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসা শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি সুদহার পাচ্ছে বলে জানা গেছে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় হিসাব খোলা ও পরিচালনা করা সহজ। ছাত্রছাত্রীরা তাদের বাবা-মা অথবা বৈধ অভিভাবকের সঙ্গে যৌথ নামে হিসাব খুলতে পারে। মাত্র ১০০ টাকা প্রাথমিক জমা দিয়ে বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যাংক শাখায় এ হিসাব খোলা যায়। এ হিসাবে কোনো ফি বা চার্জ আরোপ করা হয় না। এমনকি ন্যূনতম স্থিতি রাখার বাধ্যবাধকতাও নেই। স্কুলশিক্ষার্থীদের হিসাব থেকে বেতন-ফি পরিশোধ করা যায়। এটিএম কার্ডেও এটা পরিশোধ করা যাচ্ছে। ফলে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অভিভাবকদের স্কুলে বেতন-ফি দিতে হচ্ছে না। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে নিতে পারে শিক্ষাঋণ। খুশির খবরটি হচ্ছেÑএই কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মধ্যে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল’ (সিওয়াইএফআই)-এ ‘কান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ পায় বাংলাদেশ।
জানা গেছে, স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় খোলা হিসাবগুলোর ৫৮.৬০ শতাংশই বেসরকারি ব্যাংকে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে হিসাব রয়েছে ৩০.৭৩ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় ১০.৫২ শতাংশ এবং বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ০.১৩ শতাংশ। অনেক অভিভাবক সন্তানের ব্যাংক হিসাবে টাকা রেখে দিচ্ছেন তার পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য। আবার উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থী মা-বাবার কাছ থেকে লেখাপড়ার খরচের টাকা নিয়ে ব্যাংক হিসাবে জমা করছে। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করছে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় হিসাব খোলার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকটিতে শিক্ষার্থীদের হিসাব রয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৬২৩টি, যা মোট হিসাবের ১৬.৯৯ শতাংশ। এরপর অগ্রণী ব্যাংকে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪০৩টি হিসাব রয়েছে। এ ছাড়া ডাচ্-বাংলায় শিক্ষার্থীদের এক লাখ ২৩ হাজার ১৭২টি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে ৯৯ হাজার ৪২টি এবং উত্তরা ব্যাংকে ৭৮ হাজার ৯৮১টি হিসাব রয়েছে। টাকা জমার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এই ব্যাংকটিতে শিক্ষার্থীদের ৩৪২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা রয়েছে, যা মোট জমা থাকা টাকার ৩৩.৬০ শতাংশ। এরপর ইসলামী ব্যাংকে ১০৬ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৯১ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৫৬ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকে ৫৫ কোটি টাকার স্থিতি রয়েছে।
আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ স্কুলের ছাত্রছাত্রী। স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সঞ্চয়ের অভ্যাস ছেলেমেয়েদের মনে এনে দেবে আর্থিক শৃঙ্খলা, যা তাদের সুশৃঙ্খল জীবন গঠনেও সহায়ক হবে। জানা গেছে, স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে ‘স্কুল ব্যাংকিং কনফারেন্স’ সম্পন্ন করেছে। এসব হিসাবকে বীমার আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা আরো সুযোগ-সুবিধায় স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমকে গতিশীল করে তুলতে পারি। তা করতে পারলে এর সুফলও পাবে রাষ্ট্র ও জনগণ।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
"