আবু বকর
আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত
পৃথিবীর বুকে এক টুকরো সার্বভৌম দেশ, যা সে দেশের? জনগণকে স্বাধীন, নিরাপদ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। বিংশ শতাব্দীর আলোচিত ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাতিগত দ্বন্দ্ব সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় আজ বিশ্ব দরবারে। যার মধ্যে বিগত কয়েক দশক ধরে নানা ধরনের ঘটনার জন্ম দিয়ে আসা বর্তমানে সবচেয়ে নজর কেড়েছে ‘মধ্যপ্রাচ্য সংকট’ যার অন্যতম হলো ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন’ ইস্যু। নানা ঘটনার জন্ম দেওয়া এই ইস্যুর নেপথ্যে রয়েছে জাতিগত দ্বন্দ্ব, ধর্মীয়, বাণিজ্যসহ অনেক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ৫টি বড় যুদ্ধসহ অনেক খণ্ড যুদ্ধে বিনা প্রশ্নে প্রাণ সঁপে দিতে হয়েছে কোটি কোটি নিষ্পাপ মানুষকে। শান্তির বার্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বিশ্ব মোড়লদের স্বার্থের জন্য ফিলিস্তিনে যে অপরিণামদর্শিতার কাজ হচ্ছে, তাতে মানুষের মৌলিক অধিকার আজ বিশ্ব কাঠগড়ায়। মধ্যপ্রাচ্যের ‘ক্যানসার’ নামে খ্যাত ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মকে ঘিরে এই সংকটের সূচনা। এ ঘটনার কারণ জানতে হলে চলে যেতে হবে এর শেকড় সন্ধানে।
একটু ভিন্ন চোখে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় সব ধর্মীয় অনুসারীদের সার্বভৌম রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে। যে রাষ্ট্র ও ক্ষমতার প্রভাব বলয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা সেই ধর্মীয় জাতিকে সমর্থনসহ বিভিন্নভাবে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে দেয়। এর মাধ্যমে সেই জাতি প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য লৌহ শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর এই সুবিধার শূন্যতা অনুভব থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইহুদি প্রধান এক দেশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। সময়টা ছিল ২ নভেম্বর ১৯১৭ যখন ব্রিটিশ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতা ব্যারন রথচাইল্ডের কাছে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদিদের জন্য এক সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ব্যক্ত করেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত হয়। ১৯১৪-১৮ সালে সংগঠিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের বীরত্বগাথা উসমানীয় সাম্রাজ্যের গৌরবান্বিত মহান সূর্য চিরকালের জন্য অস্তমিত হয়। ফলে এই সাম্রাজ্য চলে যায় তৎকালীন বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর কাছে। তখন উসমানীয় সাম্রাজ্যের ফিলিস্তিন অংশ চলে যায় ব্রিটিশদের কাছে। ১৯২২ সালের ২৪ জুলাই ‘লিগ অব নেশনস’র পক্ষ থেকে ব্রিটিশদের ফিলিস্তিন শাসন করার ‘ম্যান্ডেট’ দেওয়া হয়। এর ফলে ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের উপনিবেশ হয়ে ওঠে, যা চলে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে পর্যন্ত।
১৯৩৯-৪৫ সালে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনের যে বেপরোয়া ভাব হিটলারের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিল, তাতে ইহুদিদের জন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আরো জোরদার হয়। তৎকালীন বিশ্ব মোড়লরা এই সুযোগ নিয়ে ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরে। পরে ২ নভেম্বর ১৯১৭ সালে লেখা আর্থার জেমস বেলফোরের চিঠি আবারও আলোচনায় আসে। তখন বিশ্বনেতারা তাদের স্বার্থ, ধর্মীয়, অর্থ, ক্ষমতাসহ নানা কারণে ‘বিশ্ব বিবেক’খ্যাত জাতিসংঘের মাধ্যমে এই ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উত্থাপন করে। পরে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করে ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনেদের ও ৫৫ শতাংশ ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ করে। ফলে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত করা হয়। জাতিসংঘের এই ঘোষণার পরপরই ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আসা শুরু করে। এ বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে তৎপর ছিল ব্রিটিশরা, যাদের অধীনে ফিলিস্তিন ছিল। আরব বিশ্ব এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে সংঘটিত হয় একাধিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আরব অঞ্চলের মধ্যে এক অনারব ভূখণ্ড, যা প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই ওতপ্রোতভাবে কাজ করে আসছে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই সমর্থন করে আসা মিত্র দেশগুলোর রয়েছে অনেক স্বার্থ। বিভিন্ন পর্যালোচনা করলে বাণিজ্য, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, ভূরাজনীতি ইত্যাদি বিষয় ওঠে আসে।
ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ২০ অক্টোবর, ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইসরায়েলকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট হেরি কে ট্রুম্যানের সাবেক ব্যবসায়ী অংশীদার অ্যাডওয়ার্ড জ্যাকব ইসরায়েল রাষ্ট্রের মার্কিন স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ইউরোপকে পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের ‘মার্শাল প্ল্যান’ একক আধিপত্যের আসনে বসিয়ে দেয়। আর বৈশ্বিক মার্কিন বাজার ও প্রভাব বিস্তার টিকিয়ে রাখতে মধ্যপ্রাচ্যে তেল ও সুয়েজ খালের কৌশলগত সুবিধা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন সংঘাত বজায় রাখতে ইসরায়েলকে একতরফা সমর্থন করে আসছে। আর ইউরোপে একক কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে তার দেখানো প?থেই হাঁটছে পশ্চিমা বিশ্ব। অন্যপক্ষে, প্রথম দিকে আরবরা ধর্মীয় কারণে ফিলিস্তিনের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দিলেও, কালক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে ফাঁদে আটকে যাওয়ায় ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আজ নিশ্চুপ দর্শকে পরিণত হয়েছে। যারা শুধু নামমাত্র বিবৃতি দিয়ে নিজের দায়িত্ব সেরে নিচ্ছে।
লন্ডনের স্কুল অব আফ্রিকান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের আওতাধীন মিডলইস্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক ড. সাইয়েদ আলী আলাভি বলেন, ‘ইসরায়েলের জন্মই হয়েছে মূলত পরাশক্তিদের বিশাল সমর্থনে, যেটা ইসরায়েলের ক্ষমতায়নে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে।’
দীর্ঘ গবেষণা, দূরদৃষ্টি ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি সঙ্গে প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে আরবের বুকে আজকের এই অনারব ইহুদি প্রধান রাষ্ট্র। যার ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক, পররাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে এক শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে ইসরায়েল। মিত্র দেশ হিসেবে পেছনে যেমন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব, তেমনি বিপরীতে ছিল শত্রু ভাবাপন্ন রাষ্ট্রসমূহ। মূলত ইসরায়েলকে আরবের বুকে স্থান দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি আরব দেশগুলো। ১৯৪৮ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘আরব লিগ’-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর (মিসর, ট্রান্সজর্দান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, সৌদি আরব ও ইয়েমেন) সৈন্যরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধের ফলাফল হলো আরবদের পরাজয়।
৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের হামাসের নজিরবিহীন হামলায় ইসরায়েল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ফলে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারায়। যেই যুদ্ধাবস্থা এখনো বিদ্যমান। ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গাজা নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন হামাসের সোচ্চার ভূমিকা এখন আলোচনায়। মূলত ফিলিস্তিন দুটি ভাগে বিভক্ত। ‘পশ্চিমতীর’ নিয়ন্ত্রণ করে পিএলও’র অধীন রাজনৈতিক সংগঠন ফাতাহ। অন্যদিকে ‘গাজা’ নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক সংগঠন হলো হামাস। দুটি দলই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করলেও উভয়ের মতাদর্শ ভিন্ন। রাজনৈতিক সংগঠন ফাতাহ’র মতাদর্শ হলো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আর হামাস? জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বর্তমানে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের এই সংঘাতে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন এখন হামাসের প্রতি। এই বিবেচনায় ফাতাহ’র রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে জনগণের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মাধ্যমে ফাতাহ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দ্বি-রাষ্ট্র ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। কিন্তু হামাস তা মেনে নেয়নি। যদি হামাস এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্বে তাদের সমর্থন নিতে সমর্থ হয়, তাহলে তা ফাতাহ’র জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। ফলে পশ্চিমতীরে তাদের ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। ফলে পুরো ফিলিস্তিনে হামাসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগের। কারণ, একমাত্র হামাসই ইসরায়েলের জন্য বড় হুমকি। সম্প্রতি ইউরোপের কিছু দেশ ও অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বিবেচনায় নিয়েছে। ১২ এপ্রিল ২০২৪, আল-জাজিরার এক সংবাদ বরাতে জানা যায়, ইউরোপের আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবছে। এই স্বীকৃতির বিষয়টি ইসরায়েল-হামাসের সংঘাতের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে। এই স্বীকৃতির বিষয়টি যদি আরো ব্যাপকভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রাধান্য পায়, তাহলে হামাসের হাতে ফিলিস্তিনের একক আধিপত্য বিষয়টি আরো জোরদার হবে। ফলে হামাস হয়ে উঠতে পারে ফিলিস্তিনের একক ক্ষমতাধর রাজনৈতিক সংগঠন। তাই, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলা এই সংঘাতের অবসানের জন্য নিজস্ব স্বার্থকে প্রধান্য না দিয়ে জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করতে হবে। এর মাধ্যমেই শুধু স্থায়ী সমাধানের জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা সম্ভব।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
"