মোতাহার হোসেন

  ০৩ এপ্রিল, ২০২৪

মুক্তমত

ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী

বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বহুমাত্রিক সম্পর্কে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষ। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হৃদয়ের ও রক্তের অক্ষের রচিত। বাঙালির হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের অনন্য অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সহযোগিতা, তাদের দেশে প্রায় কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়দান, আমাদের তরুণ-যুবকসহ বিভিন্ন বয়সি বেসামরিক নাগরিকদের যুদ্ধের রণকৌশল প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সহায়তা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবায় অনন্যভূমিকা চিরদিন বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে। একই সঙ্গে আমাদের এই জনযুদ্ধে তাদের দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন এবং পশ্চিমা জান্তাবাহিনীকে পরাস্ত করতে সহায়ক হয়েছে। কাজেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনেও ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি দেশে কিছু রাজনৈতিক দল ভারতীয় পণ্য বর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনে থাকায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে এ তথ্যের অবতারণা।

বাংলাদেশ ভারত উভয় দেশই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশ প্রধানত ভারতে গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, সামুদ্রিক খাবার এবং কৃষি পণ্য রপ্তানি করে। আর ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ, চিনি, চালসহ কিছু কিছু খাদ্যপণ্য, যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক, লোহা এবং ইস্পাত রপ্তানি করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানিসহ এশিয়ায় ভারত বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। এ দুদেশের মধ্যকার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক শুরু হয় ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন প্রধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক ২৫ বছরমেয়াদি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালে বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭২ সালে মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা হলেও ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি অন্যান্য সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। এরপর থেকে দীর্ঘ ২১ বছর দেশে স্বৈরতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চলতে থাকায় দুদেশের সম্পর্কেও অবনতি অব্যাহত থাকে। ঠিক একইভাবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষতায় থাকায় এ দেশীয় পাকিস্তানের দোসর কিছু রাজনৈতিক দল দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করতে, সরকারকে অজনপ্রিয়, বিব্রত করতে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছে। মূলত এরা দেশের ও দেশের মানুষের শত্রু। এই কর্মসূচির ফলে ইতিমধ্যে পেঁয়াজের কেজিতে দাম বেড়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা।

গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের মতে বিগত করোনা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে আমদানি পণ্যের সরবরাহ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে। একই কারণে দেশে আমদানি পণ্যে মূল্য বাড়ছে। এ পর্যায়ে দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনে আমদানিনির্ভর পণ্যে দাম বৃদ্ধি এবং বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কাও তার। দিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রদত্ত বক্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশে ভারতের পণ্য বয়কটের যে একটা প্রচারণা চলছে সে সম্পর্কে তিনি অবহিত। বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের বলে মনে করেন তিনি। ভারতসহ আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের একাংশ জানিয়েছে, সাম্প্রতিক প্রচারের প্রভাব বাংলাদেশের রিটেল বাজারে পড়েছে।

এদিকে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির মোটামুটি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ যায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রচার চলতে থাকলে, সুদূর ভবিষ্যতে এই রপ্তানি সামান্য ধাক্কা খেলেও, বড় ধরনের সমস্যা ভারতের রপ্তানিকারকদের হবে না। কিন্তু বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে বাংলাদেশ এমন অভিমত স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের।

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রদত্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে কম দামে, কম খরচে যেসব পণ্য আমাদিন করা যায় তা বন্ধ হলে সেসব জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। তৃতীয় কোনো দেশ থেকে পণ্য আমদানি করা হলে, সে ক্ষেত্রেও দাম বাড়বে কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশে মাল নিয়ে যাওয়া সহজ ও সস্তা। মোটামুটিভাবে ভারত থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আসে বাংলাদেশে। আর সেই পণ্যের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা রমজানের আগে শুরু করা হয়েছে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। বিএনপি জামায়াত অত্যন্ত সুচতুরভাবে এ সময়টাকে বেছে নিয়েছে, যাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরকার চাপে পড়ে। আওয়ামী লীগ এবং ভারতবিরোধী যে একটা ‘ইকো সিস্টেম’ তৈরি হয়েছে, সেটা ইউরোপে বসে এই প্রচারণা চালাচ্ছে দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত একজন পলাতক ব্যক্তি, এমন তথ্য ওঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশের যে বিগত সময়ের যে অগ্রগতি তার ওপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের উদ্যম নিয়ে সামনে এগোতে হবে। এটা কিন্তু ভাবার কারণ নেই যে বিগত দিনগুলোতে গতানুগতিক যেভাবে আমরা এগিয়েছি সামনের দিনগুলোতে সেভাবে এগোলে চলবে না। কারণ বাংলাদেশের সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে আগামী ১০ বছরের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ২০ বছরের মধ্যে ধনী দেশে পৌঁছানো। সে জায়গায় পৌঁছাতে বাংলাদেশের বড় ধরনের অবকাঠামো এবং মানসিকতার উন্নতি দরকার। তা ছাড়া উদার বিশ্ববাণিজ্যের এই যুগে কোনো রাষ্ট্রকে ‘একা, এক ঘরে’ বা একলা চলো নীতিতে চলা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে বাস্তবতার নিরিখে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক সৌহার্দ্যরে, বন্ধুত্বপূর্ণ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে রাখতে হবে। কারণ নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতায় বাড়ে বিরোধ, বাড়ে তিক্ততা- শুধু বন্ধুত্বেই অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close