শহীদুল ইসলাম শুভ

  ০২ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

উচ্চশিক্ষায় মেয়েরা নিরাপদ কোথায়?

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে জ্ঞানের সমাহার। জ্ঞানের অতল সাগর। যেখানের জ্ঞান দিয়ে পাহাড়, পর্বত, হিমালয় ও পৃথিবীকে জয় করা যায়। যেখানে সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্বপ্ন থাকে বিশ্ববিদ্যালয়। কথায় আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেও জ্ঞান অর্জন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি জায়গাই জ্ঞানের সমাহার। কিন্তু আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা তো দূরে থাক, নাম শুনলেই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের চোখে ভেসে ওঠে শ্লীলতাহানি, মানসিক টর্চার, র‌্যাগ, যৌন হয়রানির মতো ঘটনাগুলো। বাংলাদেশে নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা এমনিতেই নানা কারণে বাঁধা, তার ওপর এমন গর্হিত কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র জায়গায় হলে তা নারীদের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। অভিভাবকরাও তাদের মেয়েদের দূরে পাঠানো বা হলে রেখে পড়ানো বন্ধ করে দেবে। আর তা হবে বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার বাধা।

বাংলাদেশে অ্যাকাডেমিক শিক্ষার শেষপর্যায় বা উচ্চশিক্ষা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের সেবার জন্য তৈরি হয়ে ওঠে। এত দিনের অর্জন বিলিয়ে দেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের তরে। সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। দেশ ও দশের সেবা করবে। মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে। নিজেকে একজন আদর্শিকে হিসেবে গড়ে তোলে। আর এ কাজের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। আর এ শিক্ষকের সম্মান একজন শিক্ষার্থীর কাছে তার মা-বাবার পরই। একজন আদর্শবান শিক্ষক তার আদর্শ দিয়ে সমাজ ও দেশ পরিবর্তন করতে পারেন। বদলে দিতে পারেন গোটা সমাজরাষ্ট্রকে। সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল তার বাস্তব প্রমাণ। যাদের আদর্শ আজও বিদ্যমান।

খুব আক্ষেপ করেই ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই কথাটি বলেছিলেন, ‘দেশ ভালো হবে, যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’ মানুষ গড়ার কারিগর হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু মানুষ হলো কোথায়? হবেইবা কী করে? যেখানে সাধু শিক্ষকের আড়ালে লুকিয়ে আছে অশ্লীল ভদ্র শয়তান, ধর্ষণকারী। যাদের উদ্দেশ্য থাকে সুযোগ বুঝে নিজের কামভাব চেতনাকে জাগ্রত করা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিন দিন যৌন নিপীড়নের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এর আকার বেড়েই চলেছে। যৌন হয়রানি ভয়ানক আকারে বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর জন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই লজ্জিত নয়, গোটা জাতি লজ্জিত। এতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই কলঙ্কিত হয় না। বিশ্বের দরবারে পুরো জাতি কলঙ্কিত হয়। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সবচেয়ে বেশি নাজুক। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৫টি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১১৪টি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫টির মধ্যে যৌন নিপীড়নের সেল আছে ৪৫টির মধ্যে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টির মধ্যে যৌন নিপীড়নের সেল আছে ৯৭টির মধ্যে। ১৬৯টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সব কটার মধ্যেই যৌন হয়রানি হয়ে থাকে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী তার সহপাঠী বা শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার। অশ্লীল আচরণের শিকার। শ্লীলতাহানির শিকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (টএঈ) কর্তৃক তথ্য অনুযায়ী গত দুই বছরে ৫টি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২৭টি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২টি করে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এটা যারা সেলে অভিযুক্ত করেছে তাদের সংখ্যা। অভিযোগ করেনি এমন সংখ্যা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন যৌন হয়রানি হয় তার একটা জরিপ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আলীম স্যার। তিনি জরিপ করেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ২০০ ছাত্রীদের নিয়ে। জরিপটি ছিল ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। তার গবেষণায় উঠে আসে যৌন নিপীড়নের ছোট্ট একটি চিত্র। তিনি বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ ছাত্রী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন না। কেন করেন না? তারও কারণ তিনি বলেছেন। যাদের দ্বারা এমন কাজ হয় তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনও নীরব ভূমিকা পালন করে। আগের ঘটনায় কোনো প্রতিকার না পেলে অন্যরাও অভিযোগ করে না। এ ছাড়া বড় কারণ অভিযোগ না করার, নিরাপত্তা হুমকি এবং চরিত্র হননের। এই নিরাপত্তা ও চরিত্র হননের ভয়ে ৯০ শতাংশ ছাত্রী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কোনো পদক্ষেপ নেন না। ওই শিক্ষকের কোর্সে ফেইলের আশঙ্কাও কাজ করে। স্যারের গবেষণায় আরো উঠে আসে যে তথ্য তা শিউরে ওঠার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রী তার সহপাঠী কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হোন। আর তার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র জুনিয়র কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার ২৪ শতাংশ। শিক্ষক কর্তৃক ৯ শতাংশ এবং বহিরাগত ১১ শতাংশ। প্রশ্ন হলো, নারীরা (ছাত্রীরা) উচ্চশিক্ষার জন্য কোন জায়গা নিরাপদ? উচ্চশিক্ষার জন্য তারা কোথায় যেতে পারে? সে পরিবেশ কী সরকার, রাষ্ট্র করে দিতে পারে? অভিভাবকরা কী নিশ্চিন্তে থাকতে পারে- এমন পরিবেশ কী করা সম্ভব?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নের তেমন শাস্তিযোগ্য আইন নেই বললেই চলে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এই আইনের প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্তু এমন সহপাঠী, শিক্ষক ও বহিরাগতদের দ্বারা নির্যাতিত হলে কঠোর আইনের প্রয়োজনও আছে। ২০০৮ সালের এক রিটের আবেদনের পরে ২০০৯ সালের ১৪ মে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেয়। কিন্তু তারও বাস্তব রূপ নেই। এমন ঘটনার জন্য ১২০ দিনের মধ্যে সমাধান করার কথা, অথচ মাসের পর মাস যায়, বছরের পর বছর পার হয়ে যায় ঘটনার কোনো সুরাহা হয় না।

যারা জাতি গঠন করার কথা, তারাই যদি এমন নোংরামি আচরণ করে তাহলে জাতি যাবে কার কাছে? আইন দিয়েইবা কী হবে? তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থী বা জাতি কীইবা শিখবে। বাবা-মায়েরা কী সার্বক্ষণিক তাদের সন্তানদের পাহারা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করবে? এমন অসুস্থ বিকৃত মস্তিষ্কের শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয় কীভাবে? টাকার জোরে, ক্ষমতার জোরে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের আচরণ কেমন, কী করত, ছাত্রজীবন কেমন ছিল তা জানার প্রয়োজন মনে করে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাঙ্গনে এমন নোংরা ঘটনা হামেশা ঘটে যাচ্ছে।

শুধু ছাত্রীরা যে যৌন হয়রানির শিকার তা নয়। বরং নারী শিক্ষকরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না। সহকর্মী হিসেবে তাদের সঙ্গে যেমন আচরণ করার কথা, তেমনি আচরণ না করে অশ্লীল ভঙ্গিতে বা কথায় আক্রমণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেউ বলতে চায় না লজ্জায়, চরিত্র হননের চিন্তা করে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, নারী তার প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই যৌন হয়রানির শিকার। যারা এমন কাজ করে তাদের নামে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে তেমন দেখা যায় না। যাও নেওয়া হয়, তা শুধু সাময়িক বরখাস্ত। যাদের স্থায়ী বরখাস্ত করা হয় তাদের নামে ফৌজদারি মামলা করা যায়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ওই পর্যন্তই নীরব। আর কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তি ও অপমানজনক কিছু করা গেলে বাকিরাও সঠিক হওয়ার পথে এগিয়ে আসত। মিডিয়ায় না আসা পর্যন্ত প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেন না। কোনো শাস্তি দেন না। প্রশ্ন জাগে, তারাও কি এটাকে সমর্থন করে? দুধকলা দিয়ে তো তারাই কালসাপ লালন করে। নইলে এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঠিক তদন্ত না করে ফেলে রাখে কীভাবে? এমন নোংরা শিক্ষকের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে তাদের ১০ বার ভাবতে হয় কেন? যৌন নিপীড়নের মতো গর্হিত কাজে কি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় লজ্জিত, জাতি লজ্জিত নয়? বিশ্ব দরবারে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কি কলঙ্কিত নয়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে একের পর এক যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটছে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই তাদের। জাতি নির্বিকার। কাদের কাছে তাদের সন্তানকে শিক্ষার জন্য পাঠাচ্ছে।

যাদের দ্বারা এমন কাজ ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহির অভাবে এমন কাজ হচ্ছে। সময়মতো তদন্ত করতে হবে। সঠিক তদন্ত করে সময়মতো রিপোর্ট জমা দিতে হবে। যত বড় প্রভাবশালী হোক, শক্তিশালী হোক প্রশাসনের ঊর্ধ্বে নয়। আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ও অপমানজনক শাস্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যারা এমন কাজ করে তারা রাজনীতিকেও কলুষিত করে। রাজনৈতিকভাবেও তাদের পাকড়াও করতে হবে। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের মতো নোংরা কাজ ও আচরণ কমে যাবে। অন্যরাও দেখে শিক্ষা নেবে। মূলত দৃশ্যমান ও অপমানজনক শাস্তিই কমাতে পারে যৌন নিপীড়নের মতো গর্হিত কাজকে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close