আসাদুজ্জামান চৌধুরী সম্রাট

  ০১ এপ্রিল, ২০২৪

মুক্তমত

সংকটের নতুন মাত্রায় বৈশ্বিক নৌবাণিজ্য

বৈশ্বিক নৌবাণিজ্যের একটি আতঙ্কের নাম জলদস্যু। প্রাচীনকাল থেকে সমুদ্রে জলদস্যুর আক্রমণের শিকার হয়েছে অসংখ্য নৌপরিবহন। তবে বৈশ্বিক নৌবাণিজ্যের ইতিহাসে ১৬৬০ থেকে ১৭৩০-এর দশককে জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ বলা হয়। পরে ২০ শতকের শেষ দিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এই জলদস্যুতার প্রবণতা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল পূর্ব আফ্রিকার জলসীমা অর্থাৎ ভারত মহাসাগর এবং লোহিত সাগরে। সাধারণত আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বদিকের উপকূলঘেষাঁ দেশগুলোকে হর্ন অব আফ্রিকা বলা হয়। উপকূলবেষ্টিত নিম্ন আয়ের এই দেশগুলোর জলসীমায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলদস্যুর বিচরণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে হর্ন অব আফ্রিকার দীর্ঘতম উপকূলবেষ্টিত দেশ সোমালিয়া সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

এ দেশের অসংখ্য জেলে ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে কেন্দ্র করে জলদস্যু বৃত্তি গ্রহণ করেন নব্বইয়ের দশকে, যা ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চরম আকার ধারণ করেছিল। পরে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের যৌথ সামরিক মহড়ার ফলে ১২১২ সাল নাগাদ সোমালি জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারত মহাসাগর রুটে আবারও জলদস্যুদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বলাবাহুল্য, সোমালিয়া জলদস্যুর পুনরুত্থানের কারণে গত কয়েক মাসের ব্যবধানে পূর্ব আফ্রিকা জলসীমায় একাধিক নৌপরিবহন জলদস্যুতার শিকার হয়েছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক নৌবাণিজ্য সংকটে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

বিশ্বের যেসব দেশের নৌপথ ঘেঁষে জলদস্যুতার বিচরণ রয়েছে, তার মধ্যে সোমালিয়ার উপকূলীয় এলাকা অন্যতম। সোমালিয়া পূর্ব আফ্রিকার দীর্ঘতম উপকূল জুড়ে অবস্থিত একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশ, যা ১৯৬০ সালে ইতালির ঔপনিবেশিক থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসন অবসানের পর সোমালিয়ায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যার দরুন গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটিতে প্রায় দুই দশকের বেশি কোনো কার্যকর সরকার ছিল না। ফলে সুদীর্ঘ উপকূল-সমৃদ্ধ পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটির জলসীমা নিরাপত্তায় কোনো কোস্টগার্ড ছিল না। এই সুযোগে সোমালিয়ার উপকূলে ইউরোপীয় জাহাজগুলো শিল্পবর্জ্য খালাস করত এবং বিপুল পরিমাণের মাছ শিকার করে নিয়ে যেত, যা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে সোমালিয়ার উপকূলের জেলেরা জাহাজগুলো দমনের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন জাহাজে আক্রমণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় সোমালিয়ান জেলেরা মাছ শিকার ছেড়ে দিয়ে লাভজনক পেশা হিসেবে জলদস্যুতাবৃত্তি গ্রহণ করেন ২০ শতকের অন্তিমকালে।

তাদের জলদস্যুতার ফলে পূর্ব আফ্রিকার জলসীমা দিন দিন নৌবাণিজ্যের সংকট দেখা দিয়েছিল, যা ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চরম রূপ ধারণ করেছিল। সোমালি জলদস্যুদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে সে সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক দেশ আন্তর্জাতিক বাহিনী নিয়ে পূর্ব আফ্রিকার জলসীমায় ব্যাপক সামরিক নজরদারি বৃদ্ধি করে। যার দরুন ২০১২ সালের নাগাদ সোমালি জলদস্যুদের আধিপত্য প্রায় স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। বলাবাহুল্য, আন্তর্জাতিক বাহিনীর নিয়মিত তৎপরতায় তখন সামুদ্রিক দস্যুতাবৃত্তির ‘বিজনেস মডেল’ কার্যকরভাবে ভেঙে পড়েছিল।

বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর সম্মিলিত সামরিক অভিযানের কারণে কয়েক বছর ধরে পূর্ব আফ্রিকার জলসীমায় জলদস্যুর আক্রমণ স্থবির হলেও ২০১৮ সালের দিকে তা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিবিসির রিয়েলেটি চেক টিমের প্রতিবেদন মতে, শুধু ২০১৮ সালেই পূর্ব আফ্রিকার জলসীমায় ১১২টি নৌপরিবহন জলদস্যুর কবলে পড়েছে। তাই বলা যায়, সোমালিয়ান জলদস্যু আবারও দিন দিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পূর্ব আফ্রিকার জলসীমায় যদিও তাদের দাপট আগের মতো চরমপর্যায়ে এখনো পৌঁছায়নি, তবে শিপিং কোম্পানির প্রতিনিধিদের তথ্য মতে, তারা গত বছর নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২০টিরও বেশি জাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালিয়েছে। যার সর্বশেষ শিকার মোজাম্বিক থেকে দুবাইগামী বাংলাদেশের পতাকাবাহী কয়লাভর্তি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্চে বাংলাদেশের মালিকানাধীন জাহাজে আক্রমণ সোমালি জলদস্যুদের ক্রমবর্ধমান দস্যুবৃত্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সোমালি জলদস্যুদের পুনরুত্থানের পেছনের অন্যতম কারণ হুতি বিদ্রোহ। লোহিত সাগরসহ পার্শ্ববর্তী জলসীমায় ইয়েমেনে-ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা বাণিজ্যিক জাহাজে বারবার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে নৌপথে সংকট সৃষ্টি করছে। হুতিদের এই হামলা ঠেকাতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীগুলো পূর্ব আফ্রিকা জলসীমায় সামরিক টহল তুলনামূলক কমিয়ে দিয়েছে। ফলে পূর্ব আফ্রিকার জলসীমায় সোমালি জলদস্যুদের উপদ্রব আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সোমালি জলদস্যুচক্রের দুই সদস্য বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, তারা প্রায় এক দশক ধরে নিষ্ক্রিয় থাকার পর এখন জলদস্যুতায় ফেরার জন্য কয়েক শ নটিক্যাল মাইল উত্তরে হুতি বিদ্রোহের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন।

পরিশেষে বলা যায়, ভারত মহাসাগরের পূর্ব আফ্রিকার জলসীমা বৈশ্বিক নৌবাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। সম্প্রতি এই জলসীমায় জলদস্যুদের পুনরুত্থানের কারণে বৈশ্বিক নৌবাণিজ্যে সংকটের সম্মুখে। তাই পূর্ব আফ্রিকার জলসীমায় জলদস্যুদের পুনরুত্থান আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুত মোকাবিলা করা একান্ত জরুরি। অন্যথায় বৈশ্বিক নৌবাণিজ্য সংকটে নতুন মাত্রা দিন দিন তীব্র হয়ে উঠবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close