খন্দকার আপন হোসাইন
আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ
রুশ-ইউক্রেনীয় সংঘাত : তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাতছানি
কোথাও সন্ত্রাসী হামলা হলে প্রথমেই ইসলামিক স্টেট (আইএস) তার দায় স্বীকার করে নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসধয় হবংি ধমবহপু থেকে প্রচারিত আইএসের দায় স্বীকারোক্তির শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। ২২ মার্চ ২০২৪ তারিখে মস্কোর ক্রাসনোগোরস্কসংলগ্ন ক্রোকাস সিটি হলে অতর্কিত সন্ত্রাসী হামলা হয়। বিস্ফোরিত বোমার আগুনে মুহূর্তেই পুড়ে ছারখার হয় ক্রোকাস সিটি হল। কাতারভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল-জাজিরা ও ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ১৪৩ জন নিহত এবং ১৫০ জন গুরুতর আহত হয়েছে। যথারীতি এ হামলার দায়ও স্বীকার করেছে আইএস। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রুশ নিরাপত্তা বাহিনীর তাৎক্ষণিক অভিযানে আটক হয়েছে সন্দেহভাজন ১১ জন। ইউক্রেন সীমান্তের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেন ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হলো? সন্দেহজনক এই একটি প্রশ্ন আইএসের স্বীকারোক্তি ভিত্তিহীন করে দিয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার এই ভয়াবহ ঘটনায় ইউক্রেনকে অভিযুক্ত করেছে দেশটির পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিনের অভিযোগ নিঃসন্দেহে অবদমিত রুশ-ইউক্রেনিয় যুদ্ধ ত্বরান্বিত করবে। রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ মূলত রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার একটি চলমান ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত। এই সংঘাত সৃষ্টির মূল নায়ক ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে সে দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হয়। সেই সময় ভিক্টর ইয়ানুকোচ ছিল রাশিয়া সমর্থিত ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট। গণআন্দোলনের জোয়ারে ভিক্টর ইয়ানুকোচ ক্ষমতাচ্যুত হয়। ঠিক ওই সময় সুযোগ বুঝে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের দখল নেয় ভ্লাদিমির পুতিন। রুশ প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় ক্রিমিয়া উপদ্বীপটি। দখলকৃত উপদ্বীপটির বৈধতা নিশ্চিত করতে ভ্লাদিমির পুতিন কিছু পুরোনো নথি প্রদর্শন করে। যেখানে যুক্তি দেখানো হয় ১৯৫৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির আগে ক্রিমিয়া তৎকালীন রুশ প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইউক্রেনের অংশে রাশিয়ার একতরফা দখলদারিত্ব নিয়েই মূলত রুশ-ইউক্রেনিয় যুদ্ধের দীর্ঘসূত্রতা। ‘ব্রুকিংস’ নামক এক সংস্থার বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, ‘ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সবচেয়ে বড় জমি দখলের নজির স্থাপন করেছে রাশিয়া।’ আবার ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের আকাশসীমায় রুশ বাহিনী হামলা করে। সেদিন থেকে রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধের পুনঃকার্যক্রম শুরু হয়।
রুশ-ইউক্রেনীয় সংঘাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপ জুড়ে এটিই সবচেয়ে বড় স্থলযুদ্ধ। প্রাথমিকভাবে ক্ষণস্থায়ী মনে হলেও এই যুদ্ধের স্থায়িত্ব ও অন্যান্য দেশের মনোভাব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছে। সামনের দিনগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরো বাড়বে তা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। বিভিন্ন পক্ষের আলাপ, আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে একসময়ের স্নায়ুযুদ্ধ থামানো গেলেও কোনোভাবেই রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধাবস্থার সমাধান হচ্ছে না। বরং চলমান সংঘাত প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন বাঁক নিচ্ছে। আসলে তেমন কোনো সমঝোতা কিংবা আলোচনার উদ্যোগও নেই কোনো পক্ষের। উভয় দেশই যুদ্ধজয়ে নানা কৌশলের খেলা খেলছে। উভয় পক্ষই সমঝোতার দরজা বন্ধ করে রেখেছে। ক্রমেই এই যুদ্ধ সর্বগ্রাসী রূপে পৃথিবীর মানব সম্প্রদায়কে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। চিন্তাশক্তির নার্ভ নিশ্চল করে দিচ্ছে। ইচ্ছে না থাকলেও যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ভাবনার আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রকে যুদ্ধের ময়দানে এনে দাঁড় করাচ্ছে। যুদ্ধজয়ে রাশিয়া তার মিত্রদের পরামর্শ ও নির্দেশনামতো আগ্রাসী ভূমিকা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। আবার পশ্চিমা জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত সমর্থনে ইউক্রেনও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
এ যুদ্ধের প্রথম দিকে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর পরোক্ষ প্রভাব থাকলেও বর্তমানে তাদের সম্পৃক্ততা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ এমনই এক যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, যাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করা হয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞার প্রতি রাশিয়া মোটেও শ্রদ্ধাশীল নয়। বরং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে রুশ রণনীতিতে আরো আগ্রাসী ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়েছে। যার প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা কঠিন আকার ধারণ করছে।
রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ রাশিয়ার শিক্ষিত জনগণের আলোচনার প্রধান ইস্যু। কেননা এই যুদ্ধের কারণেই দেশটির বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা। ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ছয়টি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২৭টি সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা ইইউ কাউন্সিল প্রকাশিত বিবৃতি অনুযায়ী, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৪৯ রিজার্ভ ফ্রিজ করা হয়েছে। রাশিয়ান ব্যাংকগুলোকে সুইফট আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। রাশিয়া এবং ইইউ মধ্যকার অর্থনৈতিক লেনদেন প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এই নিষেধাজ্ঞা আমদানি-রপ্তানিতেও প্রভাব ফেলেছে। এমনকি রাশিয়ান নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণেও শর্তযুক্ত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাশিয়া। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জার্মানের একটি তদন্তকারী সংস্থার তথ্যানুযায়ী আজ অবধি কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে এত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি। এই যুদ্ধে সহস্রাধিক রুশ সেনার রক্ত ঝরেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাশিয়ার সাধারণ জনগণের মতামত বরাবরই পুতিনের যুদ্ধনীতি-বিরুদ্ধ। তাই ২০২৪ সালের ১৭ মার্চের জাতীয় নির্বাচনে পুতিনের ভরাডুবির সংবাদই প্রত্যাশা করেছিল বিশ্ববাসী। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর সবাই অবাক। ভ্লাদিমির পুতিন ৮৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ছে। যেখানে অধিকাংশ ভোট তরুণসমাজের। রেকর্ডসংখ্যক ভোটে পঞ্চমবারের মতো রুশ প্রেসিডেন্ট হলেন তিনি। উচ্চ ভোটার উপস্থিতির হার ও প্রেসিডেন্ট পদে জনসমর্থন যুদ্ধসহ পুতিনের সব সিদ্ধান্তের প্রতি রুশ জনতার বৈধতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শামিল। এখন পুতিন যেকোনো মূল্যে যুদ্ধ জয়ের চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, নপাম বোমার মতো মারণাস্ত্র নিক্ষেপে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করবে না। এ রকম পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিষয়ক অনেক গবেষক মনে করেন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউক্রেনকেই ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কেননা চলমান যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেন। রুশ হামলায় বিধ্বস্ত প্রায় পুরো দেশ। নিহতের সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউক্রেনে হাজার হাজার সাধারণ নিরস্ত্র নারী-পুরুষ নিহত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে গ্রামের সবুজ পরিবেশ। মিশে গেছে তিল তিল করে গড়ে তোলা শহর, বন্দর, নগর। অন্যদিকে এই যুদ্ধ এক রকম গায়েবি সুরে অনেক দেশকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে। তাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণধ্বনি থামাতে ইউক্রেনকে তার নিজ ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে হবে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় বোর্ড একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। তা হলো ইউক্রেনের জনগণই সময়ের প্রয়োজনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। আপসের স্বার্থে ইউক্রেনের নেতাদের বেদনাদায়ক আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র কোনো দিন এক সিদ্ধান্তে চলেনি। যেখানে আছে রাশিয়ার সমর্থন, সেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনেও রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন ছিল রাশিয়ার বিপরীতে পাকিস্তানকে সরাসরি সহযোগিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে চীন-ইউএসএ বৈরী সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। রুশ-ইউক্রেন প্রসঙ্গে সংগত কারণেই চীনের সমর্থন রাশিয়ার প্রতি। এই যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে প্রত্যক্ষ কার্যক্রম শুরু করলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর রোষানলে পড়বে চীন। এতে মহাসংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। মহাবিপর্যয় সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রে সুসজ্জিত রাশিয়া। আবার কৌশলগত অস্ত্র চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’-এর শর্তে ভ্লাদিমির পুতিন একমত নয়। কৌশলগত অস্ত্র চুক্তির শর্ত অবজ্ঞা করা পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কারই হাতছানি দেয়। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকেই যথোপযুক্ত মনে করে কি না ভাবনার বিষয়।
এ ছাড়া রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বে পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শন প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। এই সম্ভাবনা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। কেননা কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর প্রকাশ্য রূপ আমরা দেখতেও পাচ্ছি, যা হচ্ছে মূলত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস। তবে রাশিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র চীন এক বিবৃতিতে রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ বন্ধে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। শান্তি সংলাপের মাধ্যমে রাশিয়ায় পশ্চিমা প্রশাসনের একতরফা নিষেধাজ্ঞার অবসানও চায় চীন। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সব দেশ পারমাণবিক বোমা হামলার ঘোরতর বিরোধী। তাই এক মুহূর্তের জন্যও এই যুদ্ধকে অগ্রসর হতে দেওয়া ঠিক হবে না। অতিদ্রুত ‘সমঝোতাণ্ডআলোচনার’ ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। জাতিসংঘের যুদ্ধবিরোধী ভূমিকা জোরদার করতে হবে। কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে এখনই বিশ্ব উদ্যোগে রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে। যুদ্ধ নয় ভালোবাসা দিয়ে বিশ্ব জয় করতে হবে। প্রীতি ও মানবিক বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে পুরো পৃথিবী।
লেখক : শিক্ষক, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল
শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল
"